২০২৫ সালের ২৭ এপ্রিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন জানান, বাংলাদেশ শর্তসাপেক্ষে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের জন্য একটি ‘মানবিক করিডোর’ চালু করতে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), জামায়াত-ই-ইসলামি বাংলাদেশ এবং জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল এই প্রস্তাবনা সম্পর্কে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। পরবর্তীতে ২৯ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, বাংলাদেশ রাখাইন প্রদেশের জন্য করিডোর বানাবে না, বরং জাতিসংঘ কর্তৃক রাখাইন প্রদেশে মানবিক সাহায্য প্রেরণের জন্য ‘লজিস্টিক্স সাপোর্ট’ প্রদান করবে।
‘মানবিক করিডোর’ (humanitarian corridor) বলতে সাধারণত এমন একটি অসামরিকীকৃত (demilitarized) অঞ্চলকে বোঝায় যেটি দিয়ে নিরাপদে খাদ্য, বস্ত্র, ঔষধ ও অন্যান্য মানবিক সহায়তা পাঠানো যায় এবং যেটির মাধ্যমে সংকটাপন্ন অঞ্চল থেকে শরণার্থীদের অন্যত্র স্থানান্তর করা যায়। বসনিয়া-হার্জেগোভিনা এবং সিরিয়ায় এরকম ‘মানবিক করিডোর’ স্থাপন করা হয়েছিল, কিন্তু সেগুলো তেমন কার্যকর হয়নি।
২০২৩ সালের ২৭ অক্টোবর থেকে রাখাইন জাতীয়তাবাদী আরাকান আর্মি মিয়ানমার সশস্ত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। মিয়ানমারের সৈন্যদের একের পর এক যুদ্ধে পরাজিত করে তারা রাখাইন প্রদেশের প্রায় ৯০% ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। বর্তমানে মিয়ানমার সরকারের হাতে রাখাইন প্রদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের অংশবিশেষ (রাজধানী সিত্তে ও কিয়াকপিউ বন্দর) ব্যতীত প্রদেশটির আর কোনো অংশের নিয়ন্ত্রণ নেই। মিয়ানমার সরকারের ঘনিষ্ঠ মিত্র চীন কিয়াকপিউয়ে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর ও একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিচালনা করে। সম্প্রতি চীন কিয়াকপিউয়ে অবস্থিত চীনা প্রকল্পগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সেখানে মার্সেনারি মোতায়েন করেছে।

যুদ্ধের ফলে রাখাইন প্রদেশের অর্থনীতি গুরুতর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ২০২৪ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত জাতিসংঘ উন্নয়ন প্রকল্পের (ইউএনডিপি) একটি প্রতিবেদনে আশঙ্কা ব্যক্ত করে যে, ২০২৫ সালের মার্চ-এপ্রিল নাগাদ রাখাইন প্রদেশে দুর্ভিক্ষের অনুরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। এরপর থেকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা রাখাইন প্রদেশের জন্য একটি ‘মানবিক করিডোর’ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়ে আসছে। রাখাইন প্রদেশের উপকূলীয় অঞ্চল মিয়ানমার সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকায় সমুদ্রপথে রাখাইন প্রদেশে মানবিক সহায়তা প্রেরণ করা সম্ভব নয়। সেজন্য উক্ত ‘মানবিক করিডোর’ সৃষ্টির জন্য তারা এতদিন বাংলাদেশকে আহ্বান জানিয়ে আসছিল। গত ২৭ এপ্রিল বাংলাদেশ নীতিগতভাবে এই আহ্বানে সাড়া দিয়েছে।
বাংলাদেশ যদি রাখাইন প্রদেশের জন্য বাংলাদেশি ভূখণ্ড ব্যবহার করে একটি ‘মানবিক করিডোর’ সৃষ্টি করে, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ কিছু সুবিধা পেতে পারে।

প্রথমত, রাখাইন প্রদেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে সেখান থেকে রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি রাখাইন শরণার্থীদেরও বাংলাদেশে চলে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। রাখাইন প্রদেশে খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী প্রবেশ করতে দিলে এই পরিস্থিতি এড়ানো যাবে।
দ্বিতীয়ত, রাখাইন প্রদেশের জন্য একটি ‘মানবিক করিডোর’ সৃষ্টি করলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে এবং এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে অবস্থানরত প্রায় ১৪ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্য অতিরিক্ত মানবিক সহায়তা নিয়ে আসা সম্ভব হবে।
সর্বোপরি, রাখাইন প্রদেশ আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে এবং প্রদেশটির জন্য একটি ‘মানবিক করিডোর’ খুললে আরাকান আর্মি লাভবান হবে। এই বিষয়টি ব্যবহার করে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের রাখাইন প্রদেশের উত্তরাঞ্চলে প্রত্যাবাসনের জন্য আরাকান আর্মির উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
অবশ্য, এর বিপরীতে রাখাইন প্রদেশের জন্য সৃষ্ট ‘মানবিক করিডোর’ বাংলাদেশের জন্য উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।

প্রথমত, বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, প্রস্তাবিত ‘মানবিক করিডোর’টির উদ্দেশ্য মূলত রাখাইন প্রদেশের জনসাধারণের জন্য মানবিক সহায়তা প্রেরণ নয়, বরং মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আরাকান আর্মিকে সহায়তা করা।
উল্লেখ্য, মার্চে রাখাইন প্রদেশে আরাকান আর্মির একটি আক্রমণাভিযান শুরুর আগে মার্কিন সেনাবাহিনীর ‘ইউএস আর্মি প্যাসিফিক’-এর ডেপুটি কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল জোয়েল ভাওয়েল বাংলাদেশ সফর করেছেন। বিশ্লেষকদের ধারণা, যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু মিয়ানমার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে এবং রাখাইন প্রদেশে চীনা প্রভাব হ্রাস করতে চায়, সেহেতু তারা মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে আরাকান আর্মিকে সহায়তা করতে আগ্রহী এবং এজন্য তারা বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে আরাকান আর্মিকে সহায়তা করার একটি পথ সৃষ্টি করতে চায়।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ যদি রাখাইন প্রদেশের জন্য একটি মানবিক করিডোরের সৃষ্টি করে এবং এটি আরাকান আর্মিকে সহায়তা করার জন্য ব্যবহৃত হয়, সেক্ষেত্রে মিয়ানমার সরকার ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটবে। বস্তুত চীনা–মার্কিন দ্বন্দ্বে সরাসরি কোনো একটি পক্ষ অবলম্বন করা বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশ কার্যত ২০১৫ সাল থেকে তার সীমান্ত অঞ্চলে আরাকান আর্মির জন্য একটি অনানুষ্ঠানিক ‘মানবিক করিডোর’ চালু রেখেছে। আরাকান আর্মি নির্বিঘ্নে বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চল থেকে খাদ্যদ্রব্য, ঔষধপত্র প্রভৃতি সংগ্রহ করতে পেরেছে। অন্যদিকে, আরাকান আর্মি বরাবরই প্রচারমাধ্যমে বলে এসেছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পুনর্বাসনে তাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু রাখাইন প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ লাভের পর আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য কিংবা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সমঝোতা স্থাপনের জন্য কোনো উদ্যোগই নেয়নি। উল্টো তারা মংড়ু ও বুথিডংয়ে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালিয়েছে, বহুসংখ্যক রোহিঙ্গা গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রেরণের জন্য তাদের উপর নানাভাবে চাপ দিচ্ছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশে নতুন করে অন্তত ১,১৩,০০০ রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রবেশ করেছে। সুতরাং আরাকান আর্মির কাছ থেকে কোনো ধরনের ছাড় আদায় না করে আরাকান আর্মি-নিয়ন্ত্রিত রাখাইন প্রদেশের জন্য ‘মানবিক করিডোর’ চালু করা বাংলাদেশের জন্য লাভজনক নয়।
সর্বোপরি, বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে রাখাইন প্রদেশের জন্য ‘মানবিক করিডোর’ চালু করলে সেটির মাধ্যমে বাংলাদেশে অস্ত্রশস্ত্র, মাদকদ্রব্য, শরণার্থী কিংবা বিদেশি গুপ্তচরদের অনুপ্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। এর ফলে বাংলাদেশের জন্য নতুন করে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হবে।
অর্থাৎ, রাখাইন প্রদেশের জন্য ‘মানবিক করিডোর’ চালু করলে বাংলাদেশের লাভও হতে পারে, আবার ক্ষতিও হতে পারে। বাংলাদেশ কীভাবে করিডোরটিকে পরিচালনা করবে, লাভ বা ক্ষতির মাত্রা সেটির উপরেই নির্ভর করবে।