জানুয়ারি মাসে হোয়াইট হাউসে প্রত্যাবর্তনের মাত্র কয়েকদিন পরই ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আকাশ দুর্ভেদ্য বর্মে ঢেকে ফেলার জন্য নতুন এক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলবেন তিনি। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তার ভবিষ্যৎ এই আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘গোল্ডেন ডোম’ তার প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ‘সম্পূর্ণভাবে চালু’ হয়ে যাবে। খবর বিবিসি বাংলা।
প্রথম ধাপে ২৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ট্রাম্প বলেন, পুরো প্রকল্পের মোট ব্যয় প্রায় ১৭৫ বিলিয়ন ডলার হবে বলে তিনি ধারণা করছেন। তবে কর্মকর্তারা সতর্ক করে বলেছেন, এর প্রকৃত খরচ চূড়ান্ত পর্যায়ে কমপক্ষে এর তিন গুণ হতে পারে। এই পরিকল্পনায় স্থল, সমুদ্র এবং মহাকাশ জুড়ে ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্মের’ প্রযুক্তির একটি নেটওয়ার্ক থাকবে। এর মূল অংশ হবে মহাকাশভিত্তিক ইন্টারসেপ্টর ও সেন্সর– যা শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে সক্ষম হবে।
গোল্ডেন ডোম কীভাবে কাজ করবে
ট্রাম্পের পরিকল্পনাটি আংশিকভাবে ইসরাইলের আয়রন ডোম থেকে অনুপ্রাণিত। আয়রন ডোম রাডার প্রযুক্তির মাধ্যমে স্বল্প-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত করে এবং ধ্বংস করে। ২০১১ সাল থেকে এটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে গোল্ডেন ডোম সে তুলনায় বহুগুণ বড় হবে এবং এটি আরও বিশাল পরিসরে বিভিন্ন ধরনের হুমকির মোকাবিলা করার মতো করে ডিজাইন করা হবে। এটি শত শত স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহের একটি নেটওয়ার্ক ব্যবহার করবে। এরকম ব্যবস্থা আগে খুবই ব্যয়বহুল ছিল, তবে এখন তা আরও বাস্তবসম্মত সম্ভাবনার পর্যায়ে চলে এসেছে। ট্রাম্প বলছেন, এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটি রোনাল্ড রিগান বহু বছর আগে চেয়েছিলেন, কিন্তু তখন প্রযুক্তি ছিল না। তিনি ১৯৮০-এর দশকে রিগান প্রস্তাবিত মহাকাশ-ভিত্তিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যা ‘স্টার ওয়ার্স’ নামে পরিচিত, সে প্রসঙ্গে বলছিলেন। গোল্ডেন ডোম, পৃথিবীর অপর প্রান্ত বা মহাকাশ থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রও আটকাতে পারবে। এটি এমনভাবে তৈরি করা হবে যেন ক্রুজ এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে পারে, যার মধ্যে শব্দের গতির চেয়ে দ্রুত গতিতে চলতে সক্ষম হাইপারসনিক অস্ত্রও রয়েছে। এছাড়া ফ্র্যাকশনাল অরবিটাল বম্বার্ডমেন্ট সিস্টেম বা ফোবস যা মহাকাশ থেকে ওয়ারহেড ছুড়তে সক্ষম, সেগুলো থেকেও সুরক্ষা দেওয়ার মতো করে প্রস্তুত করা হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার অন সাইবার অ্যান্ড টেকনোলজি ইনোভেশনের সিনিয়র ডিরেক্টর, অবসরপ্রাপ্ত রিয়ার অ্যাডমিরাল মার্ক মন্টগোমেরি বিবিসিকে বলেন, গোল্ডেন ডোম তিন বা চারটি গ্রুপে বিভক্ত শত শত স্যাটেলাইটের ওপর নির্ভর করবে। বিবিসির নিউজডে প্রোগ্রামে তিনি জানান, প্রথমে থাকবে শত শত স্যাটেলাইট যা উৎক্ষেপণ পর্যায় শনাক্ত করবে। এরপর থাকবে এমন সিরিজ যা ট্র্যাকিং করবে এবং ফায়ারিং নিয়ন্ত্রণের কাজ করবে। এবং সবশেষে থাকবে অস্ত্র বহনকারী এনগেজমেন্ট স্যাটেলাইট, যেগুলো মূলত গতিশীল অস্ত্র বা শত্রুর ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করার জন্য।
ট্রাম্পের ২য় মেয়াদে কি গোল্ডেন ডোম তৈরি সম্ভব?
সাবেক অ্যাডমিরাল মন্টগোমেরি বলেন, এই মিশন বা প্রকল্প পুরোপুরি সঠিকভাবে বাস্তবায়নে পাঁচ থেকে দশ বছর লাগতে পারে। তবে তিনি আরও বলেন, আগামী তিন বছরের মধ্যেই কিছু ব্যবস্থা হবে যা আমাদের আরও নিরাপদ করবে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু ১০০% সুরক্ষিত সিস্টেম ট্রাম্পের মেয়াদে তৈরি সম্ভব নয় বলে জানান তিনি।
কার নেতৃত্বে তৈরি হবে গোল্ডেন ডোম?
মার্কিন স্পেস ফোর্সের জেনারেল মাইকেল গেটলাইনকে এই মাল্টি-বিলিয়ন ডলারের গোল্ডেন ডোম প্রকল্পের নেতৃত্বে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মার্কিন সেনাবাহিনীর এই শাখাটি ক্ষেপণাস্ত্র সতর্কতা, মহাকাশ ডোমেন সচেতনতা, ন্যাভিগেশন, যোগাযোগ ও মহাকাশ ইলেকট্রনিক যুদ্ধের দায়িত্ব পালন করে। গেটলিন, একজন ফোর স্টার জেনারেল যাকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একজন অত্যন্ত প্রতিভাবান ব্যক্তি হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যার মহাকাশ এবং ক্ষেপণাস্ত্র সনাক্তকরণের উল্লেখযোগ্য অভিজ্ঞতা রয়েছে।
রাশিয়া ও চীন কী বলছে গোল্ডেন ডোম নিয়ে?
গোল্ডেন ডোম মূলত রাশিয়া ও চীনের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকানোর জন্য তৈরি করা হচ্ছে। মার্কিন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার একটি সাম্প্রতিক ব্রিফিং ডকুমেন্টে বলা হয়েছে, ক্ষেপণাস্ত্র হুমকি পরিসর ও সংবেদনশীলতা, দুই দিক থেকেই বাড়বে। চীন ও রাশিয়া উভয়ই এই উদ্যোগকে গভীরভাবে অস্থিতিশীল বলে সমালোচনা করেছে। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সার্বভৌম বিষয় এবং এটি পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আবার আলোচনা শুরু করার পথ খুলতে পারে। অন্যদিকে চীন বলেছে, এই পরিকল্পনা আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাকে হুমকিতে ফেলবে, কারণ এটি মহাকাশে সামরিকীকরণ বাড়াবে এবং অস্ত্র প্রতিযোগিতার ঝুঁকি তৈরি করবে। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র যুক্তরাষ্ট্রকে এই পরিকল্পনা পরিত্যাগ করার আহ্বান জানান।
কানাডা কি গোল্ডেন ডোমে যোগ দেবে?
ওভাল অফিসে পরিকল্পনা ঘোষণা করার সময় ট্রাম্প বলেন, কানাডা এই ব্যবস্থায় যোগ দিতে চেয়েছে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কারনির অফিস থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, NORAD (নর্থ আমেরিকান এয়ারোস্পেস ডিফেন্স কমান্ড) ও সংশ্লিষ্ট উদ্যোগগুলো যেমন গোল্ডেন ডোম তাদের এই আলোচনায় থাকবে।