Ridge Bangla

সুমেরীয় সভ্যতা: সভ্যতার সুতিকাগার

সভ্যতার সূচনা চিহ্নিত হয় সেসব জাতি দিয়ে, যারা প্রাচীন পৃথিবীতে নতুন ধারণা, কৌশল ও প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছিল। মেসোপটেমিয়ার উর্বর ভূমিতে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দে গড়ে ওঠা সুমেরীয় সভ্যতা, পৃথিবীর প্রথম সুসংহত সভ্যতা হিসেবে পরিচিত।

সভ্যতার ধারণা, শিল্প, সাহিত্য, আইন, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির বিকাশের ক্ষেত্রে সুমেরীয়দের অমূল্য অবদান ইতিহাসের পাতা জুড়ে দৃশ্যমান। তাদের উদ্ভাবনগুলো শুধুমাত্র তাদের সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং পরবর্তী সভ্যতাগুলোর জন্যও এক অমূল্য অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করেছে।

শিল্পীর তুলিতে সুমেরীয় সভ্যতা; Image Source: Art Station.
শিল্পীর তুলিতে সুমেরীয় সভ্যতা; Image Source: Art Station.

সুমের অঞ্চলে মানব বসতির সূচনা খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০০ থেকে ৪০০০ অব্দের মধ্যে। যদিও গবেষকদের ধারণা, আরও আগেই কিছু গোষ্ঠী সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। উবায়িদ নামে পরিচিত এই জনগোষ্ঠী কৃষিকাজ, গবাদি পশুপালন, বস্ত্র বুনন, কাঠ ও মৃৎশিল্পে দক্ষতার পরিচয় দেয়। এমনকি তারা সমাজজীবনে বিনোদনের অংশ হিসেবে বিয়ার পান করত। উবায়িদদের কৃষিনির্ভর জনপদগুলোর আশেপাশে গড়ে ওঠে ছোট ছোট গ্রাম ও জনবসতি।

খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দ নাগাদ সুমেরীয়রা এই অঞ্চলের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে। তাদের সংস্কৃতি ছিল একাধিক স্বশাসিত শহর-রাষ্ট্রের সমন্বয়ে গঠিত, যেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো এরিদু, নিপ্পুর, লাগাশ, কিশ, উর এবং উরুক।

খ্রিস্টপূর্ব ২৮০০ অব্দের দিকে উরুক শহর তার খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে। তখন শহরটির ছয় মাইল জুড়ে বিস্তৃত প্রতিরক্ষা প্রাচীরের ভেতর ৪০,০০০-৮০,০০০ মানুষের বাস ছিল, যা সেসময় একে বিশ্বের বৃহত্তম নগরে পরিণত করে। সুমেরের প্রতিটি নগর-রাষ্ট্র ছিল সুদৃঢ় প্রাচীরঘেরা, এবং এর বাইরে গড়ে উঠত গ্রামীণ বসতি। প্রতিটি শহরের ধর্মীয় পরিচয় গড়ে উঠেছিল নিজস্ব দেব-দেবীর উপাসনার ভিত্তিতে।

The Great City of Uruk Became Sumerian Powerhouse of Technology, Architecture and Culture | Ancient Origins
উরুক নগরী; Illustration of city in Mesopotamia. (Jeff Brown Graphics)

সুমেরীয় ভাষা ও সাহিত্য

সুমেরীয় ভাষা ইতিহাসের প্রাচীনতম লিখিত ভাষা। খ্রিস্টপূর্ব ৩১০০ অব্দে এর প্রথম নিদর্শন পাওয়া যায়। পরবর্তী সহস্রাব্দে এটি মেসোপটেমিয়ার প্রধান ভাষা হয়ে ওঠে। পরে আক্কাদীয় ভাষা প্রচলিত হলেও সুমেরীয় কিউনিফর্মে আরও দুই হাজার বছর ধরে লেখা হতো। কিউনিফর্ম লিপি শুরু হয় পিক্টোগ্রাফিক চিহ্ন দিয়ে, যা পরে আক্কাদীয় ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে মেসোপটেমিয়ার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে।

খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দ থেকে সুমেরে কিউনিফর্ম লিপির ব্যবহার শুরু হয়। লেখার এই কৌশল রাজনীতি, কৃষি, আইনসহ নানা ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতো। ইতিহাসের অন্যতম প্রাচীন আইন, এর-নাম্মুর বিধিসংহিতা, খ্রিস্টপূর্ব ২৪০০ অব্দে এবলা শহরে এক প্রস্তরফলকে লেখা হয়।

সুমেরীয় কিউনিফর্ম লিপি; Image Source: Wikimedia Commons.
সুমেরীয় কিউনিফর্ম লিপি; Image Source: Wikimedia Commons.

সুমেরীয় সাহিত্যের অন্যতম উজ্জ্বল নিদর্শন হলো গিলগামেশ মহাকাব্য, যা পৃথিবীর প্রাচীনতম কাব্যগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। উরুক নগরীর কিংবদন্তি রাজা গিলগামেশকে ঘিরে রচিত এই কাব্যে উঠে এসেছে জীবনের অর্থ, মৃত্যু, বন্ধুত্ব ও অমরত্বের খোঁজের মতো গভীর মানবিক ভাবনা। মূলত সুমেরীয় মৌখিক ঐতিহ্যের ভিত্তিতে একে পরবর্তীতে আক্কাদীয় ভাষায় সংকলন করা হয়। সাহিত্যেও সুমেরীয়রা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল, যদিও তাদের রচনার অধিকাংশই আজ খণ্ডাংশে সংরক্ষিত।

গিলগামেশ; Image Source: Wikimedia Commons.
গিলগামেশ; Image Source: Wikimedia Commons.

শিল্প ও স্থাপত্য

সুমেরীয়রা স্থাপত্যকলায় নতুন মাত্রা এনেছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৩৪০০ অব্দে তাদের নির্মিত ধর্মীয় স্থাপনাগুলো প্রাচীন স্থাপত্যের প্রাথমিক নিদর্শন। ঘরবাড়ি সাধারণত কাদা ইট বা জলজ উদ্ভিদ দিয়ে তৈরি হতো। তাদের স্থাপত্যে খিলান, সমতল ছাদ এবং অলঙ্কৃত নির্মাণশৈলীর ব্যবহার লক্ষণীয়।

টেরাকোটা, ব্রোঞ্জ, মোজাইকের মাধ্যমে তারা কারিগরি উৎকর্ষের পরিচয় দেয়। মূর্তিশিল্পে তারা দারুণ নৈপুণ্য দেখায়। পাথরের স্বল্পতায় তারা ধাতু ঢালাইয়ে পারদর্শিতা অর্জন করে। আক্কাদীয় যুগে ভাস্কর্য আরও সূক্ষ্ম হয়, বিশেষ করে খ্রিস্টপূর্ব ২১০০ অব্দের ডায়োরাইট খোদাইয়ে তা পরিলক্ষিত হয়। একই সময়ে জিগুরাত নির্মাণ শুরু হয়। জিগুরাত হলো চতুষ্কোণ বা আয়তাকার, ধাপবিশিষ্ট, প্রায় ১৭০ ফুট উচ্চ বিশাল উপাসনালয়। খ্রিষ্টপূর্ব ১৭৭৯ অব্দে মারি শহরে ২০০ কক্ষবিশিষ্ট একটি রাজপ্রাসাদ নির্মিত হয়, যা সুমেরীয় স্থাপত্যের জাঁকজমকের অন্যতম এক নিদর্শন।

গ্রেট জিগুরাত অফ উর এর মডেল; Image Source: Wikimedia Commons
গ্রেট জিগুরাত অফ উর এর মডেল; Image Source: Wikimedia Commons

সুমেরীয় বিজ্ঞান

সুমেরীয় চিকিৎসাব্যবস্থা একদিকে যেমন জাদু ও ভেষজবিদ্যার উপর নির্ভরশীল ছিল, অন্যদিকে তারা প্রাকৃতিক উপাদান থেকে রাসায়নিক উপাদান পৃথক করার কৌশলেও তারা দক্ষতা দেখিয়েছে। শরীরবিদ্যা সম্পর্কে তাদের জ্ঞান ছিল বিস্তৃত, এবং প্রত্নতাত্ত্বিক খননে শল্যচিকিৎসার যন্ত্রপাতির প্রমাণও মিলেছে।

প্রকৌশলবিদ্যায় তাদের সবচেয়ে বড় অবদান হাইড্রোলিক ইঞ্জিনিয়ারিং। প্রাচীনকালেই তারা বন্যা নিয়ন্ত্রণে খাল-নালার ব্যবস্থা করে, এবং সেচব্যবস্থা উদ্ভাবনের মাধ্যমে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর পানি কৃষিকাজে ব্যবহার করতে শেখে। এই সেচব্যবস্থা প্রতিটি শাসনামলে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা হতো। স্থাপত্য ও প্রকৌশলে তাদের সাফল্য গণিত-জ্ঞানেও দক্ষতার পরিচয় দেয়। আধুনিক সময়ের হিসাব, অর্থাৎ এক মিনিটে ৬০ সেকেন্ড, এক ঘণ্টায় ৬০ মিনিট, সুমেরীয়দের অবদান।

সুমেরীয় গণিত; Image source: Christine Proust and Columbia University
সুমেরীয় গণিত; Image source: Christine Proust and Columbia University

সুমেরীয় শাসক

সুমেরীয় শাসকরা তাদের সভ্যতার স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধির জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। সুমেরীয় নগর-রাষ্ট্রগুলোর প্রত্যেক শাসক ছিল প্রশাসনিক এবং ধর্মীয় ক্ষমতার অধিকারী। তাদের মধ্যে কিছু বিখ্যাত শাসকের নাম স্মরণীয় হয়ে আছে, যেমন:

  • গিলগামেশ: উরুকের কিংবদন্তি রাজা, যার শাসনকালে শহরটি উন্নতির শিখরে পৌঁছায়। গিলগামেশের নামে গিলগামেশ মহাকাব্য রচিত, যা মানব ইতিহাসের অন্যতম প্রাচীন কাব্যগ্রন্থ।
  • উর-নাম্মু: উর রাজ্যের শাসক, যিনি এর-নাম্মুর বিধিসংহিতা রচনা করেন, যা পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন আইনগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত।
  • শুর-নাম্মু: উর রাজ্যের আরেক শাসক, যিনি প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় সামরিক জয়লাভের জন্য পরিচিত। তার শাসনকালে উর সভ্যতা আরো সমৃদ্ধি লাভ করে।

এই শাসকরা শুধু রাজনৈতিক নয়, ধর্মীয় ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন, এবং তাদের শাসনামলে নগর-রাষ্ট্রের মন্দির ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠত।

শাসক উর-নাম্মু; Image Source: Wikimedia Commons.
শাসক উর-নাম্মু; Image Source: Wikimedia Commons.

সুমেরের পতন

খ্রিস্টপূর্ব ২০০৪ অব্দে এলামীয়রা উর শহরে আক্রমণ চালিয়ে দখল করে নেয়। একই সময়ে আমোরীয়দের আগমনে সুমেরীয় জনসংখ্যা ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে। পরবর্তী পর্যায়ে এলামীয়রা আমোরীয় সংস্কৃতির সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়, যেখান থেকে গঠিত হয় ব্যাবিলনীয় সভ্যতা। এই রূপান্তরের মধ্য দিয়েই সুমেরীয়রা একক পরিচয়ে বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং মেসোপটেমিয়ার বৃহত্তর ইতিহাসের সঙ্গে মিশে যায়।

তথ্যসূত্র
  1. The Sumerians – Their History, Culture, and Character by Samuel Noah Kramer.
  2. Ancient Mesopotamia: Portrait of a Dead Civilization A. Leo Oppenheim Revised edition completed by Erica Reiner.
  3. Sumer: Cities of Eden by Dale Brown.
  4. Sumerians – World History Encyclopedia.
  5. History of Mesopotamia – Sumerian, Babylonian, Assyrian – Britannica.

আরো পড়ুন