ত্রয়োদশ শতক; পৃথিবীর বুকে চলছে ভয়ঙ্কর এক তুফান- মোঙ্গল ঝড়। চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে গোবি মরুভূমির সব জাতি একত্র হয়ে প্রতিষ্ঠা করেছে মহা পরাক্রমশালী মোঙ্গল সাম্রাজ্য। ইউরোপে ছাড়িয়ে এশিয়ার বুকে আছড়ে পড়েছে নৃশংস এই সেনাদল।
পটভূমি
চেঙ্গিস খানের হাতে ধ্বংস হয়ে যায় প্রাচ্যের বিশাল খাওয়ারিজম সাম্রাজ্য। আব্বাসি খিলাফত প্রতিরোধের চেয়ে শত্রুপক্ষের পদলেহনেই বেশি ব্যস্ত। তাতেও শেষরক্ষা হয়নি। ১২৫৮ সালে চেঙ্গিসের নাতি হালাকু খান তছনছ করে দেয় বাগদাদ। রক্তে লাল হয়ে যায় টাইগ্রিস নদী।
বাগদাদ দখলের পর আরো পশ্চিমে দৃষ্টি যায় হালাকুর। তার ইচ্ছে ছিল প্রাচ্যের অবশিষ্ট মুসলিম এলাকাগুলোও কব্জা করার। ১২৬০ সালের জানুয়ারিতে বর্তমান ইরানের বড় একটা অংশ নিয়ন্ত্রণে নেন মোঙ্গল সেনাপতি। এই অঞ্চল সেলজুক সুলতানদের অনুগত হয়ে শাসন করতেন সেলজুক শাহ। তিনি মোঙ্গলদের হাতে আটক হয়ে প্রাণ হারান।
বড় অভিযানের জন্য বর্তমান ইরানের মারাঘেহতে (Maragha) প্রস্তুতি নিতে থাকেন হালাকু। কয়েক মাস পরেই আলেপ্পোতে হামলা চালান তিনি। বাগদাদের পরিণতি দেখে টলে গিয়েছিল শহরবাসীদের আত্মবিশ্বাস। মাত্র সাত দিনের অবরোধেই শহর সমর্পণ করে দেয় তারা। অনেক লোককে হত্যা করে মোঙ্গলরা। এরপর ফিলিস্তিনের গাজা আর নাবলুসের পতন ঘটে। ইসলামি সাম্রাজ্যের কেন্দ্র সরে যায় মিশরে। হালাকু এবার সেদিকে নজর দিলেন।

মামলুক সালতানাত
মোঙ্গল বাহিনী যখন এশিয়াজুড়ে তাণ্ডব চালাচ্ছে, তখন মিশরে সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবির হাতে গড়া আইয়ুবি (Ayyubid) বংশ পতনোন্মুখ। তাদের বাহিনীতে ছিল দুর্ধর্ষ একদল সেনা- মামলুক (Mamluks)। এরা ছিল সেসব দাস যাদের যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা দিয়ে পারদর্শী করে তোলা হতো। মামলুকদের অনেকেই নিজেদের যোগ্যতার ভিত্তিতে আসীন হয়েছিল সেনাদলের উচ্চপদে।
১২৫০ সালে মারা যান সুলতান আস সালিহ আইয়ুব (as-Salih Ayyub)। তার বিধবা স্ত্রী শাজারাতুদ দুর বিয়ে করেন মামলুক আমির আইবাককে (Aybak)। আইবাক ছিলেন মিশরের প্রথম মামলুক সুলতান। এই ধারায় তৃতীয় শাসক ছিলেন সাইফুদ্দিন কুতুজ (Sayf ad-Din Qutuz)। আইবাকের অন্যতম বিশ্বস্ত সেনাপতি কুতুজ ১২৫৯ সালে ক্ষমতায় আসেন।

মোঙ্গল হুমকি
হালাকু খান মামলুক মিশর করতলগত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন আগেই। নিজ শক্তিতে পূর্ণ আস্থাবান মোঙ্গল জেনারেল কুতুজের কাছে দূত পাঠান। তাদের বয়ে আনা চিঠিতে কুতুজকে বাগদাদসহ অন্যান্য শহরের পরিণতি স্মরণ করিয়ে দেন হালাকু।
আমাদের বিরোধিতা করে অন্যান্য রাজ্যের কী দশা হয়েছে নিশ্চয়ই জানো! নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই তোমার সামনে। আমরা জয় করেছি বিস্তীর্ণ এলাকা, বইয়ে দিয়েছি রক্তগঙ্গা। আমাদের হাত থেকে পালানোর কোনো উপায় নেই! মোঙ্গল অশ্ব বিদ্যুৎগতির, তরবারি যেন বজ্র, তীর নির্ভুল লক্ষ্যভেদী। সৈন্য আমাদের অগণিত।
হালাকুর পত্রের জবাব মামলুকরা দিল অস্ত্র দিয়ে। তার দূতদের হত্যা করে কর্তিত মস্তক প্রদর্শন করা হয় কায়রোর সদর দরজায়। কুতুজ জানতেন- এর অর্থ যুদ্ধ। হেরে গেলে বাগদাদের মতো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে কায়রো। হালাকুর সামনে উন্মুক্ত হয়ে যাবে মক্কা, মদিনা আর জেরুজালেমের রাস্তা।
রণপ্রস্তুতি
হালাকু আর কুতুজ দুজনেই সমরসজ্জা আরম্ভ করেন। দুই পক্ষের মধ্য ছিল ক্রুসেডার নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল। তাদের কেন্দ্র আক্রা (Acre)। কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের জন্য হালাকু এবং কুতুজ দুজনেই ক্রুসেডারদের মিত্রতা কামনা করে পত্র দেন।
ক্রুসেডারদের কাছে দুই দলই শত্রু। তবে হালাকুকে স্বল্প মেয়াদে অধিকতর বিপদজনক বিবেচনা করল তারা। প্রকাশ্যে নিরপেক্ষতার নীতি নিলেও কুতুজকে তাদের এলাকা ধরে চলাচল ও রসদপত্র কেনার অনুমতি দেয় তারা।

হালাকু প্রায় লাখের কাছাকাছি সৈন্যসমাবেশ করেন। সেই তুলনায় মামলুক বাহিনী ছিল নগণ্য, মাত্র ২০,০০০। ঠিক সেই সময়েই খবর আসে- মোঙ্গল সাম্রাজ্যের অধিপতি মংকে খান (Möngke) মৃত্যুবরণ করেছেন। উত্তরাধিকার নিয়ে টানাপোড়নের মাঝেই হালাকুর এক ভাই আরিক-বোক হুট করে নিজেকে গ্রেট খান ঘোষণা করেন।
আরিক-বোক যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করেননি, ফলে সৃষ্টি হয় দ্বন্দ্বের। হালাকুর ছোট ভাই কুবলাইও সিংহাসন দাবি করলেন। কুবলাইয়ের সমর্থনে সেনাদলের বড় অংশ নিয়ে রাজধানী কারাকোরাম বরাবর যাত্রা করলেন হালাকু।
মামলুকদের শক্তিমত্তা নিয়ে তার খুব একটা উচ্চধারণা ছিল না। ফলে সেনাপতি কিতবুগার (Kitbuga) অধীনস্থ ২০,০০০ সেনাই যথেষ্ট হবে বলে মনে করলেন তিনি। এই দলে ছিল মুসলিম সিরিয়া, এবং খ্রিষ্টীয় আর্মেনিয়া ও জর্জিয়ার সৈনিকরাও। সিরিয়ানরা বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে- এই আশঙ্কায় তাদের সংরক্ষিত সেনাদল হিসেবে জমা রাখেন কিতবুগা।
কুতুজ এমন একটা সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন। সিনাই ধরে ফিলিস্তিনের ভেতরে ঢুকে পড়লেন তিনি। গাযায় মোঙ্গলদের ছোট একটি দলকে ছত্রভঙ্গ করে মুখোমুখি হলেন কিতবুগার। জায়গাটি ছিল জেযরেল উপত্যকায় আইন জালুতের (Ayn Jalut) মরুদ্যান। ইহুদি ধর্মবিশ্বাসে- এখানেই ডেভিড গোলিয়াথকে হত্যা করেন।
সংঘর্ষ
৩রা সেপ্টেম্বর, ১২৬০।
সৈন্যসংখ্যার হিসেবে দুই দলই প্রায় সমানে সমান। তবে মোঙ্গলরা এই এলাকার খুঁটিনাটি বিষয়ে অজ্ঞ। অন্যদিকে কুতুজের অন্যতম জেনারেল রুকনুদ্দিন বাইবার্স (Rukn al-Din Baybars) আইন জালুতের নাড়িনক্ষত্র জানেন। তিনিই কৌশল নির্ধারণ করলেন।
মামলুক বাহিনী এমনভাবে অবস্থান নেয় যাতে যুদ্ধ আরম্ভ হলে সূর্য সরাসরি মোঙ্গলদের মুখের ওপর পড়ে তাদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। বাইবার্স সেনাদের একটা বড় অংশকে লুকিয়ে রাখেন পাহাড়ের ফাঁকফোকরে, উদ্দেশ্য- মোঙ্গলদের জন্য ফাঁদ পাতা।

যুদ্ধের শুরুতে বাইবার্স নিজে ছোট একটা দল নিয়ে কিতবুগার সৈনিকদের উত্যক্ত করতে থাকেন। ঝটিকা আক্রমণ করে পিছিয়ে যাওয়ার নীতি গ্রহণ করেন মামলুক জেনারেল। একপর্যায়ে ধৈর্যচ্যুতি ঘটে কিতবুগার। চূড়ান্ত ফয়সালার জন্য সেনাদলকে অগ্রসর হতে আদেশ দেন তিনি।
বাইবার্স ঠিক এই মুহূর্তের অপেক্ষাতেই ছিলেন। ধীরে ধীরে পিছিয়ে যেতে থাকেন তিনি, মোঙ্গলদের টেনে নিতে থাকেন পাহাড়ের ভেতরে। সঠিক সময়ে লুকিয়ে থাকা সৈনিকেরা বেরিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে কিতবুগার ওপর। তীরের আঘাতে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে শত্রুদের। হাতাহাতি সংঘর্ষে মামলুকরা মিদফা (midfa) নামে বিশেষ একধরনের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে। হাতকামানের মতো এই অস্ত্রের মূল কাজ ছিল বিকট শব্দে বারুদ ফুটিয়ে শত্রুদের ঘোড়াগুলোকে আতঙ্কিত করে দেয়া।
তবে কিতবুগার সেনারা প্রচণ্ডভাবে পাল্টা আক্রমণ করে। ভয়ঙ্কর যুদ্ধে ভেঙে পড়ে মামলুকদের বাম ব্যূহ। ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাতে থাকে অনেকে। সমসাময়িক ঐতিহাসিকরা দাবি করেন- ঠিক এমন সময় কুতুজ শিরস্ত্রাণ ছুড়ে ফেলে চিৎকার করে ওঠেন, “ইসলামের জন্য!” সুলতান স্বয়ং রণক্ষেত্রে নামছেন দেখে সাহস ফিরে পায় সেনারা, তীব্রবেগে কিতবুগার ব্যুহে আঘাত করে তারা। এই দফায় নিহত হন মোঙ্গল সেনাপতি। জর্জিয়া আর আর্মেনিয়ার সেনারাও পশ্চাদপসরণ করে।
চারদিক থেকে ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে হিংস্রভাবে লড়তে থাকে মোঙ্গলরা। একপর্যায়ে তাদের একদল ব্যূহ ভেদ করে পালিয়ে যায়। মামলুকরা তাদের ধাওয়া করে যায় ১৩ কিলোমিটার দূরে বেইসানে। সেখানে রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে শত্রুরা। কিন্তু দ্রুতই নতি স্বীকার করে আবারও পিছু হটতে হয় তাদের।
এই যুদ্ধে কিতবুগার প্রায় সম্পূর্ণ বাহিনী ধ্বংস হয়ে যায়। যুদ্ধের পরপরই জয়ের সুসংবাদ নিয়ে দূত ছুটে যায় কায়রো অভিমুখে, সঙ্গে ছিল শত্রু জেনারেলের খণ্ডিত মাথা। তবে বেশিদিন জয়ের গৌরব উপভোগ করতে পারেননি কুতুজ। কায়রো ফিরে যাবার পথে আততায়ীর শিকার হন তিনি। মসনদে বসলেন বাইবার্স।
তাৎপর্য
আইন জালুতের যুদ্ধ ইতিহাসের মোড় নির্ধারণী যুদ্ধগুলোর অন্যতম। পশ্চিম এশিয়ায় মোঙ্গল অভিযানের প্রথম পরাজয় এই লড়াই। ফলে থেমে যায় তাদের পশ্চিম অভিমুখী অগ্রযাত্রা। আইন জালুতের পথ ধরে মামলুকরা ফিরিয়ে নেয় দামেস্ক, হোমস আর আলেপ্পো। মোঙ্গলরা অজেয়- এমন ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করে এই লড়াই। বিপর্যস্ত ইসলামী সাম্রাজ্যের পতাকা তুলে ধরে তাদের নতুন করে আত্মবিশ্বাস জোগায় আইন জালুতের বিজয়।
হালাকু খান প্রতিশোধের শপথ নিয়েছিলেন। কিন্তু সাম্রাজ্যের অন্যান্য দিকে ব্যস্ততার দরুণ মিশরের দিকে মনোযোগ দিতে পারেননি তিনি। তদুপরি, বাগদাদের গণহত্যার জন্য তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন স্বজাতি গোল্ডেন হোর্ডের মুসলিম শাসক বর্কে খান (Berke Khan)। ১২৬২ সালে একবার সিরিয়ায় প্রবেশ করেন হালাকু। কিন্তু মামলুকদের সাথে মিত্রতা করে বর্কে তাকে আক্রমণ করলে ফিরে যান তিনি।
হালাকুর প্রতিষ্ঠিত ইলখানাত রাজ্য তার মৃত্যুর পরেও মামলুক মিশরের সাথে বেশ কয়েকবার সংঘর্ষে জড়ায়। ১২৮১ থেকে আরম্ভ করে ১৩১২ সাল পর্যন্ত পাঁচবার তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে তারা। কেবল ১৩০০ সালে কিছু সাফল্যের মুখ দেখলেও বাকি চারবারই শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় মোঙ্গলরা। ১৩২৩ সালে সন্ধির মাধ্যমে সমাপ্ত হয় দুই পক্ষের দীর্ঘস্থায়ী এই লড়াই।
References
- Reuven Amitai-Preiss. Mongols and Mamluks: The Mamluk-Ilkhanid War, 1260-1281
- John Joseph Saunders. The History of the Mongol Conquests, (Philadelphia: University of Pennsylvania Press, 2001).
- Battle of ʿAyn Jālūt – Encyclopedia Britannica.
- Ain Jalut – A Turning Point in World History
- Ahmed, N. The Battle of Ayn Jalut