Ridge Bangla

মার্কিন শুল্ক যুদ্ধের নেপথ্যে

us tariffs

২০২৫ সালের ২ এপ্রিল মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বিদেশ থেকে আমদানিকৃত সকল পণ্যের উপর ন্যূনতম ১০% শুল্ক আরোপ করেন। সেদিন তিনি ৮২টি রাষ্ট্র ও ৪টি ভূখণ্ড থেকে আমদানিকৃত পণ্যের উপর এর চেয়েও বেশি হারে শুল্ক আরোপ করেন। ট্রাম্প এই দিনকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ‘মুক্তি দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন।

সারা বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছরে প্রায় ৩.৩৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের পণ্য আমদানি করে এবং এজন্য বিশ্বের বহু সংখ্যক রাষ্ট্রের পণ্যের জন্য যুক্তরাষ্ট্র একটি বিরাট বাজার। সুতরাং ট্রাম্পের শুরু করা ‘শুল্ক যুদ্ধ’ (tariff war) বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এক ঘটনা।

শুল্ক আরোপের কারণ              

একটি রাষ্ট্র যখন অন্য কোনো রাষ্ট্র থেকে কোনো পণ্য আমদানি করে এবং আমদানিকৃত পণ্যকে নিজ রাষ্ট্রে প্রবেশের অনুমতি দেয়ার জন্য অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে, সেটিকে বলা হয় শুল্ক। যুক্তরাষ্ট্র যে বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত পণ্যের উপর শুল্ক আরোপ করেছে, এর মূল উদ্দেশ্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্রের যে বিপুল পরিমাণ ঘাটতি রয়েছে সেটি দূর করা। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র যে পরিমাণ পণ্য অন্যান্য রাষ্ট্রের কাছে রপ্তানি করে, তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ পণ্য অন্যান্য রাষ্ট্রের কাছ থেকে আমদানি করে। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মোট বাণিজ্য ঘাটতির (trade deficit) পরিমাণ ছিল ১.২ ট্রিলিয়ন ডলার। কার্যত, বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি।

Image Source: Visual Capitalist

যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক বাণিজ্য ঘাটতির মূল কারণ হলো মার্কিন সমাজ একটি অতিমাত্রায় ভোগবাদী (consumerist) সমাজ। তারা তৈরি পোশাক ও বাচ্চাদের খেলনা থেকে শুরু করে আইফোন ও টেলিভিশনসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য কেনার জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে। এর ফলে অন্যান্য বহু রাষ্ট্রের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয় সঞ্চয়ের হার কম। যুক্তরাষ্ট্র যে বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানি করে, সেই আমদানিকৃত পণ্যগুলোর মূল্য পরিশোধের জন্য দেশটিকে বিপুল পরিমাণ ঋণ করতে হয়। অথচ যুক্তরাষ্ট্র একটি অতি উন্নত শিল্পায়িত রাষ্ট্র। সেই হিসেবে তাদের অভ্যন্তরীণ পণ্যের চাহিদা নিজেদেরই অনেকাংশে মিটিয়ে ফেলতে পারার কথা ছিল।

একসময় যুক্তরাষ্ট্রই সারা দুনিয়ায় বিপুল পরিমাণ ভোগ্যপণ্য রপ্তানি করতো। কিন্তু বিগত কয়েক দশকে মার্কিন অর্থনীতি একটি সেবাভিত্তিক অর্থনীতিতে (service-based economy) পরিণত হয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রে শিল্প উৎপাদনের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। বিশ্বায়নের ফলে বহু মার্কিন কোম্পানি তাদের কারখানাগুলো এমন সব রাষ্ট্রে সরিয়ে নিয়ে গেছে যেখানে শ্রমের মজুরি কম ও পরিবেশ রক্ষা সংক্রান্ত আইন তুলনামূলকভাবে দুর্বল।

১৯৯৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে অন্তত ৯০,০০০ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর ফলে একসময় গ্রেট লেকস এবং মধ্য আটলান্টিক অঞ্চলে অবস্থিত যে মার্কিন প্রদেশগুলো ব্যাপক শিল্প উৎপাদনের কারণে ‘ইস্পাত বলয়’ (Steel Belt) বা ‘কারখানা বলয়’ (Factory Belt) নামে পরিচিত ছিল, এখন সেই প্রদেশগুলোয় শিল্প উৎপাদন ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়েছে এবং অঞ্চলটি ‘মরিচা বলয়’ (Rust Belt) নামে পরিচিতি লাভ করেছে।

Image Courtesy: Christine Cuthbertson/Alamy

ট্রাম্প এবং তার সমর্থকরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি দীর্ঘ মেয়াদে তাদের বৈশ্বিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক আধিপত্য ধরে রাখতে চায়, সেক্ষেত্রে তাদেরকে এই অবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে এবং তাদের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমিয়ে আনতে হবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে নতুন করে ব্যাপক হারে শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি করা খুবই কঠিন। একইসঙ্গে, মার্কিন সমাজের যে ভোগবাদী প্রবৃত্তি, সেটি নিয়ন্ত্রণ করাও মার্কিন সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তার ব্যাপক বাণিজ্য ঘাটতি পূরণের একটিই কার্যকরী উপায় অবশিষ্ট ছিল: যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকৃত পণ্যগুলোর উপর ব্যাপক হারে শুল্ক আরোপ করা এবং এর মধ্য দিয়ে মার্কিন আয় বৃদ্ধি করা।

অবশ্য মার্কিন অর্থনীতিবিদদের অনেকেই মার্কিন অর্থনীতি সম্পর্কে ট্রাম্প প্রশাসনের মূল্যায়নের সঙ্গে একমত নন। তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র যেসব পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করে, সেগুলোর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মূলত মার্কিন কোম্পানিগুলোই বিদেশে অবস্থিত তাদের কারখানাগুলোয় উৎপাদন করে। তদুপরি, মার্কিন কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে লাইসেন্স নিয়ে বহু বিদেশি কারখানা এসব পণ্য তৈরি করে এবং এভাবে ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি খাত থেকে যুক্তরাষ্ট্র বিপুল অর্থ আয় করে। এর ফলে বিশ্বব্যাপী সেবা আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি নেই, বরং উদ্বৃত্ত (surplus) আছে। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন যে বাণিজ্য ঘাটতির হিসেব দিয়েছে, সেটি কেবল পণ্য আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে। সেবা আমদানি-রপ্তানির বিষয়টি এই হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

তাছাড়া, সেই অর্থনীতিবিদদের মতে, পণ্য আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র যে বাণিজ্য ঘাটতির সম্মুখীন হচ্ছে, তার মূল কারণ ভোগ্যপণ্যের জন্য মার্কিন সমাজে বিস্তৃত চাহিদা এবং মার্কিন সরকারের আর্থিক ঘাটতি (fiscal deficit)। মার্কিন সরকার বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে এবং এজন্য তাদেরকে অন্যান্য রাষ্ট্রের কাছ থেকে বিপুল অর্থ ঋণ করতে হয়। এর ফলে ডলারের মান বৃদ্ধি পায় এবং ডলার শক্তিশালী হওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানির হার বেড়ে যায়।

আরোপিত শুল্কের ধরন

যুক্তরাষ্ট্র বিদেশ থেকে আমদানিকৃত সকল পণ্যের উপর ১০% শুল্ক আরোপ করেছে এবং একে ‘বেসলাইন শুল্ক’ (baseline tariff) হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যে রাষ্ট্রগুলোর পণ্যের উপর ‘বেসলাইন শুল্ক’ আরোপ করেছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, আর্জেন্টিনা, কলম্বিয়া, সৌদি আরব, মিসর এবং তুরস্ক। ৫ এপ্রিল থেকে এই নিয়ম কার্যকর হয়েছে। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেন থেকে আমদানিকৃত একটি পণ্যের মূল্য যদি ৫ এপ্রিলের আগে ১০০ ডলার হয়ে থাকে, ৫ এপ্রিলের পর থেকে সেটির মূল্য ১১০ ডলার। 

Image Source: Reuters

সেই সাথে যুক্তরাষ্ট্র ৮২টি রাষ্ট্র এবং ৪টি ভূখণ্ডের উপর বিভিন্ন হারে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছে। একে বলা হচ্ছে ‘পাল্টাপাল্টি শুল্ক’ (reciprocal tariff)। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামের পণ্যের উপর ৪৬%, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ৩৭%, চীনের ক্ষেত্রে ৩৪%, ইন্দোনেশিয়ার ক্ষেত্রে ৩২%, ভারতের ক্ষেত্রে ২৭%, দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষেত্রে ২৫%, জাপানের ক্ষেত্রে ২৪%, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত সকল রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ২০% এবং ইসরায়েলের ক্ষেত্রে ১৭% শুল্ক আরোপ করেছে। এই শুল্কগুলো ৯ এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্রের ভিয়েতনাম থেকে আমদানিকৃত একটি পণ্যের মূল্য যদি বর্তমানে ১০০ ডলার হয়ে থাকে, ৯ এপ্রিলের পর সেটির মূল্য হবে ১৪৬ ডলার।

যুক্তরাষ্ট্র যে রাষ্ট্রগুলোর পণ্যের উপর শুল্ক আরোপ করেছে, সেগুলোর প্রায় সবগুলোর সঙ্গেই তাদের বিস্তৃত বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। সেই রাষ্ট্রগুলো যুক্তরাষ্ট্রে তাদের পণ্য রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করে থাকে। রাষ্ট্রগুলোর প্রায় সবগুলোর সঙ্গেই যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। এদের পণ্যের উপর শুল্ক আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র অতিরিক্ত অর্থ আয় করতে চায়, এবং এর মধ্য দিয়ে বিদ্যমান বাণিজ্য ঘাটতির অন্তত একাংশ পূরণ করতে চায়।

যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে দাবি করেছিল, অন্যান্য রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের উপর যে হারে শুল্ক আরোপ করে, যুক্তরাষ্ট্র সেই রাষ্ট্রগুলো থেকে আমদানিকৃত পণ্যের উপর এর অর্ধেক হারে শুল্ক আরোপ করেছে। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু বাংলাদেশি পণ্যের উপর ৩৭% শুল্ক আরোপ করেছে, সেই হিসেবে বাংলাদেশ কর্তৃক আমদানিকৃত মার্কিন পণ্যের উপর ৭৪% শুল্ক থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। বরং বাংলাদেশ কর্তৃক আমদানিকৃত মার্কিন পণ্যের উপর শুল্কের পরিমাণ অনেক কম থাকে। সুতরাং ‘পাল্টাপাল্টি শুল্ক’ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের এই দাবিটি ছিল মিথ্যে।

এমতাবস্থায় জেমস সুরোভিয়েস্কি নামক মার্কিন অর্থনীতি বিষয়ক সাংবাদিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে একটি হিসেব করে দেখান যে, যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন রাষ্ট্রের উপর যে ‘পাল্টাপাল্টি শুল্ক’ আরোপ করেছে, তার সঙ্গে ঐ রাষ্ট্রগুলোর মার্কিন পণ্যের উপর আরোপিত শুল্কের কোনো সম্পর্ক নেই। পরবর্তীতে মার্কিন সরকার প্রকাশ করে, তারা অন্য একটি হিসেবের উপর নির্ভর করে ‘পাল্টাপাল্টি শুল্ক’ আরোপ করেছে। হিসেবটি এরকম: কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে বাণিজ্য ঘাটতি আছে সেটিকে যুক্তরাষ্ট্রে ঐ রাষ্ট্র মোট যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করে সেটি দিয়ে ভাগ করা হয়েছে, এতে যে ফলাফল এসেছে সেটিকে ১০০ দিয়ে গুণ করে তার অর্ধেক পরিমাণ শুল্ক উক্ত রাষ্ট্রের উপর আরোপ করা হয়েছে।

সমীকরণটি এরকম: {(যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো রাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি ÷ যুক্তরাষ্ট্রে উক্ত রাষ্ট্রের মোট রপ্তানির পরিমাণ) × ১/২}%

উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের নিকট ৮৪০,০০,০০,০০০ ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে এবং ২২০,০০,০০,০০০ ডলার মূল্যের পণ্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করেছে। এর ফলে ২০২৪ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল = (৮৪০,০০,০০,০০০ – ২২০,০০,০০,০০০) = ৬২০,০০,০০,০০০ ডলার।

বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতিকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির পরিমাণ দিয়ে ভাগ করলে পাওয়া যায় = (৬২০,০০,০০,০০০ ÷ ৮৪০,০০,০০,০০০) = ০.৭৩৮।

০.৭৩৮ কে ১০০ দিয়ে গুণ করলে হয় = (০.৭৩৮ × ১০০) = ৭৩.৮ = ৭৪।

৭৪-এর অর্ধেক = (৭৪ ÷ ২) = ৩৭।

এই সূত্র অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের উপর ৩৭% শুল্ক আরোপ করেছে।

এভাবে যুক্তরাষ্ট্র ৮২টি রাষ্ট্র ও ৪টি ভূখণ্ডের সঙ্গে তাদের বাণিজ্য ঘাটতির হিসেবের ভিত্তিতে উক্ত রাষ্ট্র ও ভূখণ্ডগুলো থেকে আমদানিকৃত পণ্যের উপর শুল্ক আরোপ করেছে।

অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন রাষ্ট্রের উপর যে ‘পাল্টাপাল্টি শুল্ক’ আরোপ করেছে, সেটি প্রকৃতপক্ষে সেই রাষ্ট্রগুলোর শুল্ক নীতির প্রতিক্রিয়া নয়। বরং যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হচ্ছে যেসব রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে, সেসব রাষ্ট্রের উপর শুল্ক আরোপ করে তাদের সঙ্গে বিদ্যমান বাণিজ্য ঘাটতি পূরণ করা।

মার্কিন শুল্ক যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ও সম্ভাব্য ফলাফল

যুক্তরাষ্ট্র কার্যত বিশ্বের একটি বড় অংশের বিরুদ্ধে ‘শুল্ক যুদ্ধ’ আরম্ভ করেছে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়তে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘শুল্ক যুদ্ধ’ শুরুর পরপরই ওয়াল স্ট্রিটের শেয়ারবাজার অন্তত ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। সেই সাথে, অতিরিক্ত শুল্কের কারণে এই বছর মার্কিন নাগরিক ও কোম্পানিগুলোকে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্য ক্রয়ের জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হবে। ট্রাম্প প্রশাসনের ভাষ্যমতে, তাদের গৃহীত পদক্ষেপের ফলে যদি স্বল্প মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়, তাতে তাদের আপত্তি নেই, কারণ তাদের বিশ্বাস- দীর্ঘ মেয়াদে এই পদক্ষেপের ফলে যুক্তরাষ্ট্রে শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।

Image source: Global Finance Magazine

যুক্তরাষ্ট্র যেসব রাষ্ট্রের পণ্যের উপর উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করেছে, সেসব রাষ্ট্রের মধ্যে অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পাল্টা অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছে বা নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের উপর ৩৪% শুল্ক আরোপ করেছে। কিন্তু ইতিপূর্বে চীনা পণ্যের উপর আরোপিত মার্কিন শুল্ককে হিসেবে নিলে যুক্তরাষ্ট্র সামগ্রিকভাবে চীনা পণ্যের উপর প্রায় ৬০% শুল্ক আরোপ করেছে। কিছু কিছু চীনা পণ্যের উপর আরোপিত মার্কিন শুল্কের হার আরো বেশি।

২০২৪ সালে চীনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২৯,৫৪০ কোটি ডলার। ধারণা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রপ্তানির পরিমাণ ৮০% পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত শুল্ক চীনের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের গৃহীত পদক্ষেপের প্রত্যুত্তরে চীন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদনিকৃত পণ্যের উপর ৩৪% শুল্ক বৃদ্ধি করেছে। শুধু তা-ই নয়, চীন মার্কিন কোম্পানিগুলোর কাছে ১৬টি বিরল মৃত্তিকা মৌল (rare-earth metal) রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে, ১১টি মার্কিন কোম্পানির উপর কার্যত নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, মার্কিন কোম্পানি ডুপন্টের বিরুদ্ধে একক আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টার অভিযোগ এনে তদন্ত শুরু করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে মুরগি আমদানি নিষিদ্ধ করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা ছিল, তারা চীনা পণ্যের উপর উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করলে চীন অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের শর্তাবলি মেনে চলতে বাধ্য হবে। কিন্তু চীন দীর্ঘদিন ধরে বৈদেশিক বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করার জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এবং এই উদ্দেশ্যে নানা প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। সুতরাং চীন এত সহজে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক যুদ্ধের কাছে নতি স্বীকার করবে, এমন সম্ভাবনা কম।

Image source: Wharton School of the University of Pennsylvania

ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলো যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যবর্তী সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটবে। কানাডা এবং জাপানও যুক্তরাষ্ট্রের উপর অসন্তুষ্ট। অন্যদিকে, ভারত, ভিয়েতনাম, ইসরায়েল এবং বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এই তাদের উপর ঘনিয়ে আসা সঙ্কট মোকাবিলার চেষ্টা করছে। 

যে রাষ্ট্রগুলোর উপর যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক আরোপ করেছে, তাদের সামনে এখন মূলত তিনটি পথ খোলা আছে।

প্রথমত, তারা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পাল্টা শুল্ক আরোপ করতে পারে, যেমনটা চীন করেছে। কিন্তু সকল রাষ্ট্রের পক্ষে এই পন্থা অবলম্বন করা সম্ভব নয়।

দ্বিতীয়ত, তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত পণ্যের উপর শুল্ক হ্রাস করতে পারে এবং বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র যাতে তাদের পণ্যের উপর আরোপিত শুল্ক হ্রাস করে সেটির জন্য প্রচেষ্টা চালাতে পারে।

তৃতীয়ত, তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি করতে পারে এবং এর মধ্য দিয়ে বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে শঙ্কা রয়েছে সেটি দূর করতে পারে। সেক্ষেত্রে হয়তো সেই রাষ্ট্রগুলোকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সামরিক সরঞ্জাম কিনতে হবে, কারণ যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদন করে। কিন্তু সামরিক সরঞ্জামের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল হওয়া, বিশেষত দক্ষিণ গোলার্ধের রাষ্ট্রগুলোর জন্য, বেশ কঠিন, কারণ রুশ বা চীনা সামরিক সরঞ্জামের তুলনায় মার্কিন সামরিক সরঞ্জামের মূল্য অনেক বেশি। মার্কিনিরা তাদের রপ্তানিকৃত সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহারের উপর বিভিন্ন ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করে, যেটা রুশ বা চীনা বা ফরাসিরা করে না।

যুক্তরাষ্ট্র প্রায় সমগ্র বিশ্বের বিরুদ্ধে যে শুল্ক যুদ্ধ আরম্ভ করেছে, বিশ্ব অর্থনীতিতে এর ফলে মারাত্মক প্রভাব পড়বে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এই ঝুঁকি নিচ্ছে, কারণ তারা আশা করছে, এর ফলে যেসব মার্কিন কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাদের কারখানাগুলো অন্যান্য দেশে সরিয়ে নিয়ে গেছে, তাদের অনেকেই আবার যুক্তরাষ্ট্রে ফিরবে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বিশিল্পায়নের (de-industrialization) যে ধারা শুরু হয়েছে সেটি আংশিকভাবে হলেও রোধ করা সম্ভব হবে। এর ফলে একদিকে যেমন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ হ্রাস পাবে, অন্যদিকে নানাবিধ পণ্যের জন্য তাদের পরনির্ভরশীলতা হ্রাস পাবে।

প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে বড় একটা সময় যুক্তরাষ্ট্র নিরপেক্ষ ছিল। সেসময় যুদ্ধরত রাষ্ট্রগুলোর কাছে পণ্য রপ্তানির মধ্য দিয়ে মার্কিন অর্থনীতি ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল। একইসঙ্গে উভয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন বিজয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল কেন্দ্রীয় শক্তি বা অক্ষশক্তির পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প উৎপাদন বন্ধ করা সম্ভব ছিল না, কারণ যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প উৎপাদন তখন মার্কিন ভূখণ্ডে কেন্দ্রীভূত ছিল এবং নৌ অবরোধ বা বিমান হামলার মাধ্যমে মার্কিন শিল্প কারখানাগুলো ধ্বংস করা জার্মানি বা জাপানের পক্ষে সম্ভব ছিল না।

কিন্তু অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের কারণে যুক্তরাষ্ট্র এখন তার নিত্য প্রয়োজনীয় বহু পণ্যের জন্যই বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর উপর নির্ভরশীল। যদি কখনো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীন বা রাশিয়ার বড় মাপের একটি যুদ্ধ শুরু হয়, সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে তার পণ্যের চাহিদা পূরণ করা কঠিন হয়ে যাবে। এখন যুক্তরাষ্ট্রের শুরু করা শুল্ক যুদ্ধের কারণে যদি মার্কিন কোম্পানিগুলো তাদের কারখানাগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে নেয়, সেক্ষেত্রে শিল্প উৎপাদনের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র আবার বহুলাংশে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠবে এবং এর ফলে যুদ্ধের সময় তাদের অর্থনীতি অনেকটাই সুরক্ষিত থাকবে। সহজ ভাষায়, যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োজনে সমগ্র বিশ্বব্যাপী একটি অর্থনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টির মাধ্যমে হলেও দীর্ঘ মেয়াদে তার অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইচ্ছুক এবং তার নিজের সৃষ্ট বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া যদি এর ফলে থমকে যায়, তাতেও তার আপত্তি নেই।

Image source: Getty Images

অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র যে পরিকল্পনা হাতে নিয়ে শুল্ক যুদ্ধ আরম্ভ করেছে, সেই পরিকল্পনা যে বাস্তবায়িত হবেই, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। এমনটাও হওয়া সম্ভব যে এই শুল্ক যুদ্ধের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত তো হলোই না, বরং বহির্বিশ্বে মার্কিনবিরোধী মনোভাব আরো তীব্র হলো এবং যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তার অর্থনৈতিক আধিপত্য ধরে রাখাই কঠিন হয়ে গেল। ট্রাম্প প্রশাসনের নীতির কারণে ইতোমধ্যেই ব্রিটেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং কানাডার মতো ঘনিষ্ঠ ‘মিত্র’ রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক উক্ত রাষ্ট্রগুলোর উপর শুল্ক আরোপের ফলে তাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দূরত্ব আরো বৃদ্ধি পাবে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন দীর্ঘদিন ধরেই বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে একটি স্বতন্ত্র অবস্থান সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর উপর যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক ও আদর্শিক প্রভাব এত বেশি যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই প্রচেষ্টা এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের গৃহীত নীতির কারণে এরকম একটি সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে যে, ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যবর্তী দ্বন্দ্ব আরো তিক্ত হবে এবং তাদের মধ্যেকার সামরিক-রাজনৈতিক মৈত্রী ভেঙে যেতে পারে। সেই সাথে, যুক্তরাষ্ট্রের শুরু করা শুল্ক যুদ্ধের কারণে যদি ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোতে, বিশেষত জার্মানিতে, উগ্র ডানপন্থীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ঘটে, সেটি বৈশ্বিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য একটি গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

শুধু তা-ই নয়, চীন বহুদিন ধরেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের শুরু করা শুল্ক যুদ্ধের ফলে চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যবর্তী সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হতে পারে, এরকম সম্ভাবনা রয়েছে। এর ফলে চীনা–মার্কিন ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বর্তমান মার্কিনঘেঁষা অবস্থানেরও পরিবর্তন ঘটতে পারে।

বাংলাদেশের উপর প্রভাব

বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্প। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক। ৯ এপ্রিল থেকে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আমদানিকৃত বাংলাদেশি পণ্যের উপর ৩৭% শুল্ক কার্যকর হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি যেহেতু তৈরি পোশাক রপ্তানির উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল, বাংলাদেশি অর্থনীতির জন্য এটি একটি বড় মাপের ধাক্কা। যদি বাংলাদেশ এই শুল্ক কমানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে রাজি করাতে সম্মত না হয়, সেক্ষেত্রে স্বল্প ও মধ্যম মেয়াদে বাংলাদেশ একটি বড় মাপের অর্থনৈতিক সঙ্কটে নিপতিত হতে পারে।

Image courtesy: BGMEA

বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই এই সম্ভাবনা এড়ানোর জন্য কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, মার্কিন বাজারে বাংলাদেশের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে চীন ও ভিয়েতনাম, কারণ তারাও যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ তৈরি পোশাক রপ্তানি করে থাকে। যদি এমন হতো যে চীন ও ভিয়েতনামের পণ্যের উপর মার্কিন শুল্ক বজায় থাকলো কিন্তু বাংলাদেশের পণ্যের উপর মার্কিন শুল্ক হ্রাস পেলো, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে, কারণ তখন মার্কিন বাজারে চীনা বা ভিয়েতনামি তৈরি পোশাকের তুলনায় বাংলাদেশি তৈরি পোশাক বেশি সস্তা হবে এবং অধিক পরিমাণে বিক্রি হবে। কিন্তু যদি এমন হয় যে চীন বা ভিয়েতনামের পণ্যের উপর থেকে মার্কিন শুল্ক হ্রাস করা হলো কিন্তু বাংলাদেশের পণ্যের উপর মার্কিন শুল্ক বজায় থাকলো, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

চীনা–মার্কিন ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র সহজে চীনা পণ্যের উপর থেকে শুল্ক সরিয়ে নেবে, এই সম্ভাবনা কম। কিন্তু ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ভিয়েতনামি সরকার ইতোমধ্যেই শুল্ক হ্রাস করানোর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সম্পর্কে নানা ধরনের জটিলতা রয়েছে। এমতাবস্থায় মার্কিন তৈরি পোশাকের বাজারে বাংলাদেশ ভিয়েতনামের চেয়ে অসুবিধাজনক অবস্থানে পড়ে যাবে, এরকম একটি আশঙ্কা থেকেই যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক যুদ্ধ বাংলাদেশের জন্য অন্য ধরনের সমস্যাও সৃষ্টি করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বাংলাদেশি পণ্যের উপর আরোপিত শুল্ক হ্রাস করানোর জন্য বাংলাদেশ মার্কিন পণ্যের উপর শুল্ক হ্রাস করতে পারে। এদিকে চীন ইতোমধ্যেই সকল বাংলাদেশি পণ্যকে বিনা শুল্কে চীনা বাজারে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশ যদি মার্কিন পণ্যের উপর শুল্ক হ্রাস করে কিন্তু চীনা পণ্যের উপর শুল্ক হ্রাস না করে, সেক্ষেত্রে চীন–বাংলাদেশ সম্পর্কে জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ যদি ভারসাম্য রক্ষার জন্য মার্কিন পণ্যের পাশাপাশি চীনা পণ্যের উপর থেকেও শুল্ক সরিয়ে নেয়, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের বাজারে চীনা কোম্পানিগুলো সুবিধাজনক অবস্থানে চলে আসবে এবং বাংলাদেশি কোম্পানিগুলো চীনা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না।

সামগ্রিকভাবে, যুক্তরাষ্ট্রের শুরু করা শুল্ক যুদ্ধ বৈশ্বিক অর্থনীতি ও রাজনীতির উপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে চলেছে। এর ফলে ১৯৯০-এর দশক থেকে যে বিশ্ব ব্যবস্থা কায়েম ছিল, সেটির পতনের প্রক্রিয়া সম্ভবত আরো ত্বরান্বিত হতেই চলেছে।

আরো পড়ুন