রওশন জামিল ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ১৯৩১ সালের ৮ মে, ব্রিটিশ ভারতের ঢাকা জেলায় তাঁর জন্ম। ছোটবেলায় অনেকেই তাঁকে নেতিবাচক চরিত্রে দেখে ভুল বুঝতেন, কারণ তিনি এমন নিখুঁতভাবে চরিত্রে মিশে যেতেন যে দর্শকদের মনে গেঁথে যেত তাঁর অভিনয়। নৃত্যশিল্পী হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করলেও তিনি পরে নিজেকে একজন শক্তিশালী অভিনেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় স্থান দখল করে নেন।
শৈশব ও শিক্ষা
রওশন জামিলের পিতা ছিলেন আব্দুল করিম। তিনি ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স স্কুল এবং পরবর্তীতে ইডেন মহিলা কলেজে পড়াশোনা করেন। ম্যাট্রিকুলেশন পাশের পর তিনি ওয়ারীর শিল্পকলা ভবনে নৃত্য শেখেন। সেখানেই নৃত্য প্রশিক্ষক গণেশ নাথের সঙ্গে পরিচয় হয়, যিনি পরবর্তীতে গওহর জামিল নামে পরিচিত হন। ১৯৫২ সালে তাঁরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং ১৯৫৯ সালে যৌথভাবে প্রতিষ্ঠা করেন ‘জাগো আর্ট সেন্টার’। ১৯৮০ সালে গওহর জামিলের মৃত্যুর পর প্রতিষ্ঠানটি একাই পরিচালনা করতে থাকেন রওশন জামিল।
কর্মজীবন
রওশন জামিল পঞ্চাশের দশকে মঞ্চনাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’ নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে নাট্যজগতে প্রবেশ করেন। ১৯৬৫ সালে টেলিভিশনের ‘রক্ত দিয়ে লেখা’ নাটকের মাধ্যমে পেশাদার অভিনয় শুরু হয় এবং ১৯৬৭ সালে ‘আলী বাবা চল্লিশ চোর’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বড় পর্দায় আত্মপ্রকাশ করেন।
নৃত্যশিল্পী হিসেবেও তিনি প্রশংসিত হলেও সময়ের সাথে অভিনয়ে মনোনিবেশ করেন এবং একজন শক্তিশালী চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র
রওশন জামিল প্রায় ২০০টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি:
-
জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০)
-
সূর্য সংগ্রাম
-
ওরা ১১ জন (১৯৭২)
-
তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩)
-
নয়নমনি (১৯৭৬)
-
গোলাপী এখন ট্রেনে (১৯৭৮)
-
সূর্য দীঘল বাড়ী (১৯৭৯)
-
বেদের মেয়ে জোসনা (১৯৮৯)
-
চিত্রা নদীর পাড়ে (১৯৯৯)
-
শ্রাবণ মেঘের দিন (২০০০)
-
লালসালু (২০০১)
‘জীবন থেকে নেয়া’ ও ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’-তে তাঁর অভিনয় বিশেষভাবে দর্শকদের মনে দাগ কেটে যায়।
অর্জন ও স্বীকৃতি
রওশন জামিল তাঁর কর্মজীবনে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন:
-
বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেত্রী): নয়নমনি (১৯৭৬), চিত্রা নদীর পাড়ে (১৯৯৯)
-
বাংলাদেশ ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন অ্যাওয়ার্ড
-
তারকালোক পুরস্কার
-
একুশে পদক (নৃত্যকলায়, ১৯৯৫)
ব্যক্তিগত জীবন
স্বামী গওহর জামিলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল গভীর। তাঁদের যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ‘জাগো আর্ট সেন্টার’ আজও দেশের অন্যতম সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিদ্যমান।
প্রয়াণ
২০০২ সালের ১৪ মে, ঢাকায় ৭১ বছর বয়সে এই কিংবদন্তী শিল্পীর জীবনাবসান ঘটে। তাঁর অবদান ও কর্ম আজও দর্শক এবং শিল্পমহলে অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। রওশন জামিল শুধুই একজন অভিনেত্রী ছিলেন না; তিনি ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা।