২০২৫ সালের ২০ জানুয়ারি ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর থেকে যুক্তরাষ্ট্র কানাডা, ও ডেনমার্কের অন্তর্ভুক্ত গ্রিনল্যান্ড দখল করার ক্ষেত্রে আগ্রহ দেখাচ্ছে। প্রথম যখন যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রস্তাবনাগুলো উত্থাপন করেছিল, তখন বহু বিশ্লেষক ধারণা করেছিলেন যে, কানাডা ও ডেনমার্কের কাছ থেকে বাণিজ্যিক সুবিধা আদায়ের জন্য এটি যুক্তরাষ্ট্রের একটি কৌশল। কিন্তু পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের কার্যক্রম থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র সত্যিই কানাডা ও গ্রিনল্যান্ড দখল করতে আগ্রহী।
কানাডার আয়তন ৯৯,৮৪,৬৭০ বর্গ কি.মি.। এটি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র। অন্যদিকে, গ্রিনল্যান্ড ডেনমার্কের অন্তর্ভুক্ত একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল এবং সেখানে একটি শক্তিশালী স্বাধীনতা আন্দোলন চলমান। গ্রিনল্যান্ড দ্বীপের আয়তন ২১,৬৬,০৮৬ বর্গ কি.মি.। এটি পৃথিবীর বৃহত্তম দ্বীপ। কার্যত গ্রিনল্যান্ডের ভূখণ্ড ডেনমার্কের মোট ভূখণ্ডের ৯৮%।


এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের আয়তন ৯৮,৩৩,৫২০ বর্গ কি.মি.। এটি পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র যদি কানাডা ও গ্রিনল্যান্ড দখল করে নিতে সক্ষম হয়, সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের আয়তন হবে ২,১৯,৮৪,২৭৬ বর্গ কি.মি.। তখন এটি পৃথিবীর বৃহত্তম রাষ্ট্রে পরিণত হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতিপূর্বে বেশ কয়েকবার কানাডা ও গ্রিনল্যান্ড অধিকার করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। মার্কিন স্বাধীনতা যুদ্ধ (১৭৭৬–১৭৮৩) এবং ইঙ্গ–মার্কিন যুদ্ধ (১৮১২–১৮১৫) চলাকালে যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটিশ-শাসিত কানাডার উপর আক্রমণ চালায়। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই তাদের আক্রমণ ব্যর্থ হয়।
মার্কিন গৃহযুদ্ধ (১৮৬১–১৮৬৫) চলাকালে কনফেডারেট স্টেটসের প্রতি ব্রিটিশ সমর্থনের প্রতিশোধ নিতে যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটিশ-শাসিত কানাডা দখলের পরিকল্পনা করে। কিন্তু পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত হয়নি। বিভিন্ন সময়ে কানাডার বিভিন্ন মহল যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাকে একত্রিত করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে, কিন্তু সেগুলোও বাস্তবায়িত হয়নি।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ১৮৬৭, ১৯১০, ১৯৪৬, ১৯৫৫ এবং ২০১৯ সালে ডেনমার্কের কাছ থেকে গ্রিনল্যান্ড কেনার প্রস্তাব করে। কিন্তু ডেনমার্ক কোনোভাবেই এই প্রস্তাবে সম্মত হয়নি। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক কানাডা ও গ্রিনল্যান্ড দখলের বিষয়টি ট্রাম্পের ‘খামখেয়ালিপনা’ নয়, বরং শতাব্দীপ্রাচীন মার্কিন সম্প্রসারণবাদী নীতিরই অংশ।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রের কানাডা ও গ্রিনল্যান্ড দখলের জন্য এভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠার কোনো কারণই নেই। কারণ কানাডা এবং ডেনমার্ক দীর্ঘদিন যাবৎ যুক্তরাষ্ট্রের ‘বিশ্বস্ত মিত্র’। উভয়েই মার্কিন-নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য। ন্যাটো প্রতিষ্ঠার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র যে কয়টি বড় মাপের যুদ্ধে অংশ নিয়েছে, তার প্রায় সবগুলোতেই কানাডা ও ডেনমার্ক যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। সেই সাথে উভয় দেশের ভূখণ্ডে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র কানাডার সর্ববৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদার, এবং ডেনমার্কের সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্রের সুবিস্তৃত অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। অর্থাৎ, কানাডা ও ডেনমার্ক কার্যত বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত ‘অনানুষ্ঠানিক’ মার্কিন সাম্রাজ্যের ‘আদর্শ সামন্ত রাষ্ট্র’ (model vassal state)।
তাহলে যুক্তরাষ্ট্র কেন কানাডা ও গ্রিনল্যান্ড দখল করতে চাচ্ছে? বস্তুত যুক্তরাষ্ট্রের এই পরিকল্পনার পেছনে নানা ভূরাজনৈতিক, ভূ-অর্থনৈতিক, সামরিক-কৌশলগত এবং রাজনৈতিক কারণ রয়েছে।

প্রথমত, সম্প্রতি বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে আর্কটিক অঞ্চলের বরফ গলে যাচ্ছে। এর ফলে আর্কটিক মহাসাগরে জাহাজ চলাচলের পাশাপাশি এই অঞ্চল থেকে বিপুল পরিমাণ খনিজ সম্পদ উত্তোলনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়া ও চীন ইতোমধ্যেই আর্কটিকে প্রভাব বিস্তারের জন্য বিস্তৃত পদক্ষেপ নিয়েছে। আর্কটিক অঞ্চলে অবস্থিত রাশিয়ার ‘ক্রাইনি সেভের’ বা ‘এক্সট্রিম নর্থ’-এর আয়তন প্রায় ৫৫,০০,০০০ বর্গ কি.মি., আর্কটিক মহাসাগরের সঙ্গে রাশিয়ার উপকূলের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪,১৫০ কি.মি., এবং আর্কটিক মহাসাগরে রাশিয়ার এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনের আয়তন ৪৩,৪৫,২১২ বর্গ কি.মি.।
বরফ গলার ফলে আর্কটিক মহাসাগর যদি জাহাজ চলাচলের উপযোগী হয়ে ওঠে, সেক্ষেত্রে দক্ষিণাঞ্চলীয় সমুদ্রপথ (Southern Sea Route) বা সুয়েজ খাল দিয়ে এশিয়া থেকে ইউরোপে পৌঁছাতে যে সময় লাগে, উত্তরাঞ্চলীয় সমুদ্রপথ (Northern Sea Route) বা আর্কটিক মহাসাগর দিয়ে এশিয়া থেকে ইউরোপে পৌঁছাতে তার অর্ধেকেরও কম সময় লাগবে।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে উত্তরাঞ্চলীয় সমুদ্রপথের উপর রাশিয়ার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ থাকবে এবং রাশিয়া এই পথে চলমান জাহাজগুলোর কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ শুল্ক আদায় করতে পারবে। সেই সাথে, আর্কটিকের বরফের নিচে যে বিপুল পরিমাণ খনিজ সম্পদের মজুদ আছে বলে ধারণা করা হয়, তার একটি বড় অংশ রাশিয়ার হস্তগত হবে। এজন্য রাশিয়া আর্কটিকে ব্যাপক হারে সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করছে, এবং রাশিয়া বিশ্বের একমাত্র রাষ্ট্র যাদের পারমাণবিক শক্তিচালিত বরফভাঙা জাহাজের একটি বহর রয়েছে।

অন্যদিকে, আর্কটিকের সঙ্গে চীনের সরাসরি কোনো সীমান্ত নেই, কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে চীন আর্কটিক অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের দৌড়ে অংশ নিচ্ছে এবং এর পাশাপাশি তারা গ্রিনল্যান্ডে প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। চীনা রাষ্ট্রায়ত্ত চায়না কমিউনিকেশন্স কনস্ট্রাকশন কোম্পানি গ্রিনল্যান্ডের রাজধানী নুক ও ইলুলিসসাৎ শহরে দুটি বিমানবন্দর নির্মাণ করতে চেয়েছিল, হংকংকেন্দ্রিক জেনারেল নাইস গ্রুপ উত্তর-পূর্ব গ্রিনল্যান্ডে অবস্থিত একটি পরিত্যক্ত ড্যানিশ নৌঘাঁটি কিনতে চেয়েছিল, আর চীনা অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস নুকে একটি স্থায়ী গবেষণা কেন্দ্র ও একটি স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপন করতে আগ্রহী ছিল।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের চাপে ডেনমার্ক প্রতিটি প্রকল্পই বাতিল করে দেয়। সেই সাথে, চীনা কোম্পানিগুলো গ্রিনল্যান্ডের খনিজ সম্পদ উত্তোলন প্রকল্পগুলোয় আগ্রহী ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা, গ্রিনল্যান্ডিক সরকারের পরিবেশবাদী নীতি এবং চীনা কোম্পানিগুলোর ঝুঁকি গ্রহণে অনাগ্রহের কারণে এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু সম্ভাবনা রয়েছে যে, আর্কটিকে প্রভাব বিস্তারের জন্য চীন ভবিষ্যতে গ্রিনল্যান্ডকে একটি ঘাঁটিতে পরিণত করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র এতদিন পর্যন্ত আর্কটিকের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেয়নি। কিন্তু আর্কটিকে রুশ ও চীনা প্রভাব বিস্তার এবং অঞ্চলটির অপরিসীম অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কারণে এখন যুক্তরাষ্ট্রও আর্কটিকে প্রভাব বিস্তারে আগ্রহী। কিন্তু আলাস্কার আর্কটিক অঞ্চল বাদে আর্কটিকে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ভূখণ্ড নেই। আলাস্কার মাধ্যমে আর্কটিক মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনের আয়তন ৫,০৮,৮১৪ বর্গ কি.মি., যা রাশিয়ার তুলনায় অনেক কম। কিন্তু আর্কটিক মহাসাগরে কানাডার এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনের আয়তন ৫২,৯৭,৯৪৯ বর্গ কি.মি. এবং গ্রিনল্যান্ডের এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনের আয়তন ২২,৭৮,১১৩ বর্গ কি.মি.। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্র যদি কানাডা ও গ্রিনল্যান্ড দখল করে নেয়, সেক্ষেত্রে আর্কটিক মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনের আয়তন হবে ৮০,৮৪,৮৭৬ বর্গ কি.মি., অর্থাৎ রাশিয়ার প্রায় দ্বিগুণ।
দ্বিতীয়ত, কানাডা ও গ্রিনল্যান্ড বিপুল পরিমাণ খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ। কানাডায় বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম জ্বালানি তেলের মজুদ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকৃত জ্বালানি তেলের প্রায় ৬০% ও প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রায় ৯৯% কানাডা থেকে আসে। তদুপরি, কানাডা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ইউরেনিয়াম উৎপাদনকারী রাষ্ট্র। বিশ্বের মোট ইউরেনিয়াম মজুদের প্রায় ১৫% কানাডার সাসকাচুয়ান প্রদেশে কেন্দ্রীভূত।

সর্বোপরি, কানাডায় বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ, প্লাটিনাম, পটাশ, নিকেল, তামা, লৌহ, টাইটেনিয়াম, নিয়োবিয়াম, সালফার, মলিবডেনাম, কোবাল্ট, লিথিয়াম, জিঙ্ক, জিপসাম, অ্যান্টমনি, গ্রাফাইট ও অন্যান্য খনিজ সম্পদের মজুদ রয়েছে। কার্যত বিশ্বের খনিজ উত্তোলনকারী কোম্পানিগুলোর অর্ধেকের বেশির সদর দপ্তর কানাডায়।
অন্যদিকে, গ্রিনল্যান্ডে বিনিয়োগ স্বল্পতা ও পরিবেশগত কারণে খনিজ উত্তোলনের মাত্রা খুব বেশি নয়। কিন্তু দ্বীপটিতে বিপুল পরিমাণ খনিজ তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, গ্রাফাইট, তামা, নিকেল, জিঙ্ক, স্বর্ণ, হীরা, লৌহ, টাইটেনিয়াম, ভ্যানাডিয়াম, টাংস্টেন, ইউরেনিয়াম ও অন্যান্য বিরল মৃত্তিকা মৌলের (rare earth metal) মজুদ রয়েছে। বস্তুত, গ্রিনল্যান্ড বিশ্বের অল্প কয়েকটি অঞ্চলের মধ্যে একটি, যেখানে খনিজ উত্তোলনের প্রচেষ্টা এখনো পুরোদমে শুরু হয়নি।
সুতরাং, যুক্তরাষ্ট্র যদি কানাডা ও গ্রিনল্যান্ড দখল করে নেয়, সেক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ খনিজ সম্পদ যুক্তরাষ্ট্রের হস্তগত হবে, জ্বালানির ক্ষেত্রে দেশটি বহুলাংশে স্বনির্ভর হয়ে উঠবে এবং তাদের শিল্পায়ন ও সামরিকায়ন প্রক্রিয়া আরো বেগবান হবে।
তৃতীয়ত, কানাডা ও গ্রিনল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কানাডা যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হলে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত গভীরতা (strategic depth) বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে, গ্রিনল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হলে সেখানে রাশিয়া, চীন বা অন্য কোনো শত্রুভাবাপন্ন রাষ্ট্রের পক্ষে সামরিক ঘাঁটি, বিশেষত পারমাণবিক অস্ত্রসজ্জিত ঘাঁটি স্থাপন করা সম্ভব হবে না, এবং যুক্তরাষ্ট্র সম্ভাব্য সামরিক হুমকি থেকে রক্ষা পাবে।

অবশ্য বর্তমানে গ্রিনল্যান্ডে ডেনমার্কের সামরিক উপস্থিতি নগণ্য এবং গ্রিনল্যান্ডে কার্যত মার্কিন ‘সামরিক সার্বভৌমত্ব’ (military sovereignty) বিদ্যমান। তদুপরি, যুক্তরাষ্ট্র এখন দাবি করছে, গ্রিনল্যান্ডে ঘাঁটি স্থাপন করতে পারলে রুশদের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডে পারমাণবিক আক্রমণ করা সহজ ও দ্রুততর হবে। কিন্তু কার্যত রুশ ও চীনা পারমাণবিক অস্ত্রবাহী সাবমেরিন বহর ১০/১৫ মিনিটের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডে পারমাণবিক আক্রমণ পরিচালনা করতে সক্ষম, এবং এজন্য গ্রিনল্যান্ডে ঘাঁটি থাকা মস্কো বা বেইজিংয়ের জন্য আবশ্যক নয়।
চতুর্থত, ট্রাম্প ‘Make America Great Again’ (MAGA) ধারণাকে পুঁজি করে ক্ষমতায় এসেছেন এবং তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি জনতুষ্টিবাদী (populist) ও অনেকটাই কর্তৃত্ববাদী (authoritarian)। মার্কিন লিবারেলদের সঙ্গে ট্রাম্প ও তাঁর সমর্থকদের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মাত্রা অত্যন্ত তীব্র। এমতাবস্থায় কানাডা ও গ্রিনল্যান্ডকে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীভূত করতে পারলে ট্রাম্পের রাজনৈতিক অবস্থান মজবুত হবে এবং তাঁর ও তাঁর অনুসারীদের পক্ষে মার্কিন রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করা সহজতর হবে।

সর্বোপরি, স্নায়ুযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যে একমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, সেটি দ্রুত ভেঙে পড়ছে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত বিবর্তনের কারণে মার্কিন সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য হুমকির মুখে পড়েছে। এমতাবস্থায় ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বজায় রাখার পরিবর্তে নিজস্ব প্রভাব বলয়কে সুসংহত করার উপর জোর দিচ্ছে। কানাডা ও গ্রিনল্যান্ড দখলের উদ্যোগ এই প্রক্রিয়ারই অংশ। কার্যত ক্ষীয়মান যুক্তরাষ্ট্রের জন্য রাশিয়া বা চীনের মতো মহাশক্তিগুলোর সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার পরিবর্তে কানাডা ও ডেনমার্কের মতো ‘আদর্শ সামন্ত রাষ্ট্র’গুলোর উপর খড়গহস্ত হওয়া সহজ।
বস্তুত, যুক্তরাষ্ট্রের কানাডা ও গ্রিনল্যান্ড উভয় ভূখণ্ডকে দখল করে নেয়ার মতো সামরিক সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক তার ঘনিষ্ঠ ‘মিত্র’ রাষ্ট্রগুলোর আক্রমণের ফলে বিশ্বব্যাপী মার্কিন ‘মিত্র’ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যে তীব্র রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে এবং কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রে অঙ্গীভূত করার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে রিপাবলিকানদের উপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, সেই রাজনৈতিক ঝুঁকি যুক্তরাষ্ট্র নিতে চাইবে কিনা, সেটিই দেখার বিষয়।