বাংলাদেশে সরকারি সেবা পেতে ঘুষ দেওয়ার প্রবণতা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। সাম্প্রতিক একাধিক জরিপে উঠে এসেছে, সেবাগ্রহীতা নাগরিকরা এখনো সরকারি দপ্তরে নানা ধরনের সেবা নিতে গিয়ে ঘুষ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত ‘সিটিজেন পারসেপশন সার্ভে’ এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
বিবিএসের জরিপে দেখা যায়, সরকারি চাকরিজীবীদের একটি অংশ বিভিন্ন কৌশলে সেবার বিনিময়ে ঘুষ নিচ্ছেন। প্রায় ৩৩ শতাংশ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সরাসরি ঘুষ নেওয়ার সঙ্গে যুক্ত। আবার তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ঘুষ নেওয়ার হারও প্রায় সমান। ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বা পরোক্ষভাবে ঘুষ নেওয়ার প্রবণতাও রয়েছে, যা জরিপে ২১ শতাংশের বেশি হিসেবে উঠে এসেছে।
জরিপ অনুসারে, মফস্বলের কর্মকর্তারা সরাসরি ঘুষ নেওয়ায় শহরের তুলনায় এগিয়ে। শহরে এই হার ২৭.৭৮ শতাংশ হলেও গ্রামাঞ্চলে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৪.৭০ শতাংশে। আবার শহরের কর্মকর্তারা তুলনামূলকভাবে বেশি ঘুষ নেন তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে। অর্থাৎ ঘুষ নেওয়ার ধরন ও কৌশলে ভৌগোলিক পার্থক্য স্পষ্ট।
জরিপের আরেকটি চাঞ্চল্যকর দিক হলো, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অধিকাংশই ঘুষ হিসেবে নগদ অর্থ গ্রহণ করেন। ৯৮ শতাংশের বেশি ঘুষ লেনদেন হয় নগদ টাকায়। তবে শুধু টাকা নয়, এর সঙ্গে ভ্রমণের টিকিট, হোটেল ভাড়া, মূল্যবান উপহার, খাবারদাবার এমনকি জমি বা ফ্ল্যাট নেওয়ার নজিরও পাওয়া গেছে।
জরিপ অনুযায়ী বিআরটিএ, ভূমি অফিস, পাসপোর্ট বিভাগে ঘুষ লেনদেন হয় সর্বোচ্চ। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সবচেয়ে ঘুষ-দুর্নীতিপরায়ণ দপ্তর। জরিপে অংশ নেওয়া নাগরিকদের ৬৩ শতাংশ বলেছেন, বিআরটিএতে সেবা নিতে গিয়ে ঘুষ দিতে হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে এই হার প্রায় ৬২ শতাংশ, পাসপোর্ট অফিসে ৫৭ শতাংশ এবং ভূমি অফিসে ৫৫ শতাংশ।
এমনকি ঘুষ দাবি না করলেও অনেক নাগরিক স্বেচ্ছায় ঘুষ দিয়ে থাকেন তাড়াতাড়ি সেবা পাওয়ার আশায়। এ ধরনের ঘুষদানে শহরের নাগরিকদের আগ্রহ তুলনামূলক বেশি, যা স্বেচ্ছায় ঘুষ দেওয়ার সংস্কৃতিকে আরও শক্তিশালী করছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রতিবেদন অনুসারে, তারা গত ১১ মাসে ৩৯৯টি দুর্নীতির মামলা করেছে, যাতে আসামি হয়েছেন ১ হাজার ২৬৪ জন। এর মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন ২৪৩ জন, যা মোট আসামির প্রায় ২৭ শতাংশ। এছাড়া দুদকের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঘুষ ছাড়াও সম্পদ পাচার, টেন্ডার দুর্নীতি, জমি দখল, অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অন্যান্য অপরাধে জড়িত।
এই একই সময়ে প্রায় ১২ হাজারের বেশি অভিযোগ জমা পড়ে দুদকে, যার বড় অংশই সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি সেবা পেতে ঘুষ দেওয়া যেন এখন একটি ‘গৃহীত বাস্তবতা’তে রূপ নিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, এটি নাগরিকের অধিকারহরণ। ঘুষ ছাড়া সেবা না পাওয়া যেমন লজ্জাজনক, তেমনি এটি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতারও প্রতিফলন।
তিনি আরও জানান, ঘুষবিরোধী ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি কেবল কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বাস্তবে এর বাস্তবায়ন চোখে পড়ে না। স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সুশাসনের অভাবে দুর্নীতির সংস্কৃতি দিন দিন আরও গভীর হচ্ছে।
ঘুষ ও দুর্নীতি যে শুধু প্রশাসনিক অনিয়ম নয়, তা স্পষ্ট হয়ে উঠছে নানা জরিপ ও অনুসন্ধানে। ঘুষ যেন এখন সরকারি সেবার ‘অঘোষিত শর্ত’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই চর্চা বন্ধ করতে না পারলে সাধারণ নাগরিকরা প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হবেন, আর রাষ্ট্র হারাবে নাগরিকদের আস্থা। বিশ্লেষকদের মতে, কেবল আইন প্রয়োগ নয়, দরকার প্রশাসনিক সংস্কার, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার বাস্তবায়ন।