Ridge Bangla

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি, আত্মত্যাগে শ্রমজীবী শ্রেণি সর্বোচ্চ

গত বছরের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পেরিয়ে আজও সেই দিনগুলোর বেদনাদায়ক স্মৃতি দগদগে হয়ে আছে দেশের শ্রমজীবী ও মধ্যবিত্ত মানুষের মনে। বৈষম্য, বেকারত্ব, শোষণ, দুর্নীতি ও সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে জনতার এই রুখে দাঁড়ানোর দিনগুলোতে ছাত্র জনতা ও শিশু-কিশোরদের মধ্যে সর্বাধিক প্রাণ হারিয়েছেন শ্রমজীবী মানুষ। তাঁদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে রাজপথ।

এই গণ-অভ্যুত্থান চলাকালে বিভিন্ন পর্যায়ে অন্তত ২৮৪ জন শ্রমজীবী শ্রমিক ও কর্মজীবী মানুষ প্রাণ হারান, যা শহীদদের মধ্যে সর্বোচ্চ। রিকশা, অটোরিকশাচালক, ট্রাকচালক ও সহকারী, নির্মাণশ্রমিক, দোকান ও রেস্তোরাঁর কর্মী, পোশাক শ্রমিকসহ নানা পেশায় যুক্ত এই মানুষদের মৃত্যু শুধু সংখ্যায় বড় নয়, তা সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকেও সমাজ ব্যবস্থায় গভীর প্রভাব ফেলেছে।

সরকার প্রকাশিত গেজেট অনুযায়ী আন্দোলনে শহীদদের তালিকায় থাকা ৮৪৪ জনের মধ্যে ৮১০ জনের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে তাদের পরিচয়, বয়স ও পেশা যাচাই করা সম্ভব হয়েছে। বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই শহীদদের ৩৫ শতাংশই শ্রমজীবী, ৩৩ শতাংশ শিক্ষার্থী, ১৫ শতাংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী এবং ১৩ শতাংশ বেসরকারি চাকরিজীবী।

এই আন্দোলনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রাণ হারিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। প্রায় ২৬৯ জন শিক্ষার্থী প্রাণ হারিয়েছেন, যাদের মধ্যে বড় একটি অংশ ১৮ বছরের কম বয়সী। এদের মধ্যে রয়েছে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও প্রযুক্তি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। জানা গেছে, প্রায় ১৩৩ জন শিশু ও কিশোর নিহত হয়েছে এই আন্দোলনে।

উত্তরার এক অভিভাবক সামিরা জাহান জানান, তাঁর ১৬ বছরের ছেলে মাহিন চাকরিতে বৈষম্যের প্রতিবাদ জানাতে আন্দোলনে অংশ নেয় এবং পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। সে বলেছিল, চাকরি না পেলে লেখাপড়ার কী দরকার, মরে গেলেও প্রতিবাদ করবে। নিজের জীবন দিয়েই সে তা প্রমাণ করেছে।

এই গণ-অভ্যুত্থানে শ্রমজীবী মানুষদের অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক এবং অনেক ক্ষেত্রে নেতৃস্থানীয়। বিশেষ করে ঢাকা মহানগরীর যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, উত্তরা ও রামপুরা এলাকাগুলোতে শ্রমজীবীদের সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। এই পাঁচটি এলাকায় কমপক্ষে ৩২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে, যার বেশির ভাগই শ্রমজীবী মানুষ।

যাত্রাবাড়ীর এক অটোরিকশাচালক রাজীব হোসেন আন্দোলনের সময় গুলিতে প্রাণ হারান। তাঁর বাবা তোফাজ্জল হোসেন জানান, রাজীব ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাঁর মৃত্যুর পর স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে পরিবার গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হয়।

সাভার, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এই শিল্পাঞ্চলগুলোতে পোশাকশ্রমিক ও অন্যান্য শ্রমিক শ্রেণির বসবাস বেশি। সাভারে নিহত হন ৬৫ জন, গাজীপুরে ৩৬ জন এবং নারায়ণগঞ্জে ৩৪ জন।

শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ বলেন, “বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে শ্রমিকেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেন। অনেকে তো কাজে যাওয়ার সময়ই রাস্তায় প্রাণ হারিয়েছেন।”

গবেষণায় দেখা গেছে, শহীদদের মধ্যে ৭৯ শতাংশের বয়স ৩৫ বছরের নিচে—অর্থাৎ ৬৩৮ জন। এদের মধ্যে ১৮ বছরের নিচে প্রায় ১৭ শতাংশ শিশু ও কিশোর। নিহতদের ৯৫ শতাংশ কর্মক্ষম বয়সে ছিলেন (১৫-৬৪ বছর), যা দেশের অর্থনীতির জন্য এক বিশাল ক্ষতি। বেশির ভাগ নিহতই প্রাণ হারিয়েছেন প্রাণঘাতী গুলিতে, যদিও পিটিয়ে, কুপিয়ে ও আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের এক প্রতিবেদন অনুসারে, আন্দোলনের সময় ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্টের মধ্যে প্রায় ১,৪০০ জন নিহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ৬৬ শতাংশই রাইফেলের গুলিতে, ১২ শতাংশ শটগানের গুলিতে এবং ২ শতাংশ পিস্তলের গুলিতে প্রাণ হারান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংখ্যা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, “এই আন্দোলনের তরুণেরা সাহসিকতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। গুলির মুখেও তারা পিছু হটেনি। শিশু-কিশোরদের এই আত্মত্যাগ ইতিহাসে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।”

পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী শেখ শিহাবউদ্দিন বলেন, “আমরা রাস্তায় নেমেছিলাম শুধু নিজেদের নয়, সবার অধিকারের জন্য। রক্ত দেখেছি, বন্ধু হারিয়েছি—তবু মনে করি, প্রতিবাদ না করলে মানুষ থাকা যায় না।”

আরো পড়ুন