২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া যখন ইউক্রেনে আক্রমণ করে, তখন থেকেই ট্রাম্প বলে আসছিলেন, তিনি যদি প্রেসিডেন্ট থাকতেন তাহলে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে কখনোই ইউক্রেনে আক্রমণ করতে দিতেন না। আবার, তিনি যদি পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে আসেন, তাহলে প্রথমদিনেই ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ বন্ধ করবেন।
না, প্রথমদিনেই যুদ্ধ সমাপ্ত করতে পারেননি। তবে তার হস্তক্ষেপে সাময়িক একটা যুদ্ধবিরতিতে আসতে রাজি হয়েছে রাশিয়া। এই উদ্দেশ্যে কাজ করতে গিয়ে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে হোয়াইট হাউজে পুরো বিশ্বের মিডিয়ার সামনে অপমান করেছেন ট্রাম্প, যেখানে তাকে কিছু ক্ষেত্রে পুতিনের মুখপাত্রই মনে হচ্ছিল।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই মরিয়া হয়ে ওঠা কেবল যুদ্ধবিরতির জন্য কিংবা রুশপ্রীতির জন্য নয়। তিনি রাশিয়ার চেয়ে বড় হুমকি হিসেবে দেখছেন চীনকে। ইউক্রেন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ একাট্টা হয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নামায় চীন-রাশিয়া সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হয়েছে। চীন এই যুদ্ধে নিরপেক্ষ অবস্থান রাখায় চীনের প্রতি রাশিয়ার নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ট্রাম্প চাইছেন রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে চীন-রাশিয়ার ঐক্যে ফাটল ধরাতে, যেন যুক্তরাষ্ট্রকে একইসাথে দুই পরাশক্তির বিরুদ্ধে লড়তে না হয়।

সত্তরের দশকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের কূটনৈতিক তৎপরতায় প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন চীন সফর করলে প্রায় ২৫ বছর পর দেশটির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়। এর পেছনে কাজ করে সোভিয়েত-চীন দ্বন্দ্ব, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র সুবিধা আদায় করে নেয়। ট্রাম্প সমর্থকরা পুতিনের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়কে ‘রিভার্স নিক্সন’ কৌশল হিসেবে দেখছেন। তবে সমালোচকরা বিষয়টি এত সহজ ভাবছেন না। কারণ দুই সময়ের প্রেক্ষাপট আর বাস্তবতা ভিন্ন।
১৯৫৩ সালে স্ট্যালিনের মৃত্যুর তিন বছর পর সোভিয়েত শাসক নিকিতা ক্রুশ্চেভ কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলনে স্ট্যালিন যুগের কড়া সমালোচনা করেন। চীনের মাও সে তুং একে দেখেন মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে। তিনি তখন বৈশ্বিক সমাজতন্ত্রের অভিভাবক হওয়ার চেষ্টা করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি শুরু করেন গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড, যার মাধ্যমে চীনের সমাজতন্ত্রকে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের চেয়ে শ্রেয়তর প্রমাণের চেষ্টা ছিল। ক্রুশ্চেভ এর সমালোচনা করেন।
আদর্শিক দ্বন্দ্ব আরো বিস্তৃত হতে সময় নেয়নি। ১৯৬০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন চীন থেকে তাদের সকল প্রকার উপদেষ্টাদের সরিয়ে নেয়, যার মাঝে চীনের পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণে সহায়তাকারী ব্যক্তিবর্গরাও ছিলেন। তখন তারা আমেরিকানদের সাথে সহযোগিতা শুরু করে, যেন পারমাণবিক দ্বৈত আধিপত্য বজায় রাখতে পারে। মাও তখন এসব নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।
ষাটের দশকের শেষের দিকে সীমানা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে সোভিয়েত-চীন ছোটখাট সামরিক সংঘর্ষও হয়। তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন চীনের উপর পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের চিন্তাও করে। ১৯২০ এর দশকে সোভিয়েত এজেন্টরা যেখানে চীনের কমিউনিস্ট পার্টিকে সহায়তা করেছিল, চার দশক পর তাদের নিজেদের সীমান্ত নিয়ে বিরোধেই যুদ্ধাবস্থার দিকে যাচ্ছিল।

এরই প্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালে কিসিঞ্জার এবং ১৯৭২ সালে নিক্সন চীন সফর করেন। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে দুই বৈরি দেশের সম্পর্ক তলানির মধ্যে থাকার সুযোগ নিতে পেরেছিল। মাও সে তুংকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে আনার জন্য সেরকম বড় কোনো চ্যালেঞ্জ ছিল না। স্নায়ুযুদ্ধের তুলনায় বর্তমান বাস্তবতা ভিন্ন।
২০২২ সালে পুতিন ইউক্রেনে আক্রমণ করার আগে বেইজিং সফরে যান শীতকালীন অলিম্পিকে। তখন দুই দেশের মধ্যে ‘বন্ধুত্বের কোনো সীমা নেই’ উল্লেখ করে যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। শি জিনপিংয়ের অনুরোধে ইউক্রেন আক্রমণের সময়টা শীতকালীন অলিম্পিক শেষ হওয়া পর্যন্ত পিছিয়ে দেন পুতিন। চীন খুব সতর্কতার সাথে এই আক্রমণের প্রতিক্রিয়া দেয়। জাতিসংঘে যখন পশ্চিমা জোট রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়, চীন সেখানে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকে।
পশ্চিমা দেশগুলোর অন্তত ১,০০০টি কোম্পানি রাশিয়া থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়ে গেছে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর হওয়ার পর। তখন চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কই রাশিয়ার জন্য অক্সিজেন হয়ে আসে। রাশিয়া চীনের কাছে তখন ছাড় দিয়ে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস বিক্রি করে। চীনা পণ্যেরও বড় বাজার হয়ে ওঠে রাশিয়া। ২০২১ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত রাশিয়ায় চীনের ৭০ শতাংশ রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ২০২১ সালে যেখানে ছিল ১৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, সেখানে ২০২৪ সালে সেটা দাঁড়িয়েছে ২৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে অন্তত ২,১৯২টি স্যাংশন দিয়েছে। সেখানে চীনই রাশিয়ার ত্রাতা হয়ে এসেছে।
তবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে চিরস্থায়ী শত্রু বা বন্ধু বলে কিছু নেই, আছে শুধু চিরস্থায়ী স্বার্থ। যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার নিকটবর্তী অঞ্চলগুলো থেকে ন্যাটোর ঘাঁটি সরিয়ে নেওয়া, স্যাংশন তুলে নেওয়া, ইউক্রেনের দখলকৃত অঞ্চলগুলো রাশিয়ার অংশ বলে স্বীকৃতি দিয়ে পরাশক্তি দেশটির সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের মিত্র ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ভরসা রাখতে পারছে না। ইতোমধ্যে তারা সামরিক খাতে বাজেট বৃদ্ধি করছে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা কমানোর জন্য।

অন্যদিকে রাশিয়াও কেবল ট্রাম্পের ওপর ভরসা করে চীনের সাথে জোট ভেঙে দেওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ট্রাম্পের উদ্যোগগুলো ২০২৮ পরবর্তী সময়ে চলমান থাকবে কিনা তার নিশ্চয়তা নেই। চীন-রাশিয়া দুই দেশই যুক্তরাষ্ট্রকে নিজেদের নিরাপত্তার হুমকি মনে করে। তাদের মধ্যে আলোচনার সময় যুক্তরাষ্ট্র তাদের সম্পর্কে কীভাবে ফাটল ধরাতে পারে, সেরকম সম্ভাব্য বিষয় নিয়েও আলোচনা হয়। তাছাড়া স্নায়ুযুদ্ধ নিয়ে কেবল আমেরিকানরাই পড়াশোনা করেছে এমন নয়।
নিক্সন যখন চীনের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেন, তখন চীন-সোভিয়েত সম্পর্ক ইতোমধ্যেই চিড় ধরা ছিল। বর্তমানে তাদের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। ২০১২ সালে শি জিনপিং ক্ষমতায় আসার পর থেকে পুতিনের সাথে অন্তত চল্লিশবারেরও বেশি সাক্ষাৎ হয়েছে। ট্রাম্প যেখানে ২০২৮ সাল পর্যন্ত থাকবেন, শি জিনপিং অন্তত আরো এক দশক ক্ষমতায় থাকার সম্ভাবনা আছে। তাই অন্তত চীন-রাশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানদের পরিবর্তন না আসা পর্যন্ত দুই দেশের সম্পর্কে ফাটল ধরার সম্ভাবনা কম।
তাছাড়া ট্রাম্প খোদ নিজের দেশেই এই প্রসঙ্গে কেমন সমর্থন পাবেন, তা নিয়ে সংশয় আছে। নিক্সন যেখানে কট্টর কমিউনিস্টবিরোধী ছিলেন, ট্রাম্পের গায়ে একটা দাগ লেগে আছে প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পেছনে রাশিয়ার ভূমিকা থাকার অভিযোগে। সুতরাং, ট্রাম্পের পক্ষে ‘রিভার্স নিক্সন’ কৌশল কাজ না করার সম্ভাবনাই বেশি।