উনবিংশ শতকের প্রথমভাগ যুদ্ধের ঘনঘটার সময়। নেপোলিয়নের ফরাসি শক্তির সাথে লড়তে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তৈরি করেছে ইউরোপিয়ান কোয়ালিশন। উত্তর আমেরিকাতেও ছড়িয়ে পড়েছিল সংঘর্ষের আঁচ। যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু প্রতিবেশি কানাডা তখনও ব্রিটিশ শাসিত। মার্কিনিরা নিরপেক্ষ থেকে সব পক্ষের সাথেই ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যেতে আগ্রহী। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে সেটা দ্রুতই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
১৮০৬ সালে বার্লিন ডিক্রির (The Berlin Decree) মাধ্যমে ব্রিটিশদের সাথে ব্যবসা করা যেকোনো পক্ষকে শত্রু বানিয়ে দেন নেপোলিয়ন। এর জবাবে ১৮০৭ সালে নতুন আইন করে ব্রিটিশরা। ফরাসি বন্দর অভিমুখী বাণিজ্য জাহাজ তল্লাশি এবং যুদ্ধের জন্য ব্যবহার করা যাবে এমন দ্রব্য বাজেয়াপ্তের বিপুল ক্ষমতা পায় রয়্যাল নেভি। যুক্তরাষ্ট্র পড়ে যায় উভয় সংকটে।
মার্কিন আইনপ্রণেতারা সাগরে রয়্যাল নেভির বাড়াবাড়িতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। ব্রিটিশরা মার্কিন জাহাজ থেকে নাবিকদের ধরে নিয়ে যুদ্ধে লাগিয়ে দিচ্ছিল। কানাডার সীমান্তে আদিবাসী ইন্ডিয়ানদের সাথে অভিবাসী মার্কিনিদের ঝগড়াবিবাদও অসন্তোষের পালে হাওয়া দিচ্ছিল। অভিবাসীরা আদিবাসীদের জায়গা দখল করে নিচ্ছিল। এর প্রতিবাদে ইন্ডিয়ানরা ব্রিটিশদের মিত্র হিসেবে বেছে নেয়। ফলশ্রুতিতে অভিবাসীরা ধরে নিয়েছিল- ব্রিটিশদের কানাডা থেকে উৎখাত করলে সহজেই ইন্ডিয়ানদের দমন করা যাবে। কানাডা দখল করে নেয়ার সুপ্ত ইচ্ছেও ছিল কারো কারো মনে।
উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে ১৮১২ সালের জুনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ম্যাডিসন (Madison) যুদ্ধ ঘোষণা করেন। কোনো পক্ষই আসলে সেভাবে প্রস্তুত ছিল না। ব্রিটিশদের সেনাশক্তির প্রায় পুরোটাই ইউরোপে, কানাডাতে ভরসা স্থানীয় মিলিশিয়া আর হাতে গোণা কয়েকজন সেনা অফিসার। ব্রিটিশ সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল স্যার আইজাক ব্রকের (Isaac Brock) হাতে মাত্র ১৫০০ রাজকীয় সৈন্য।

যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি রাজ্যও যুদ্ধের বিরোধী। পেশাদার সৈনিকদের বদলে তাই সরকার মূলত সশস্ত্র নাগরিকদের ব্যবহার করছিল। জেনারেলরা তো প্রেসিডেন্টকে বলেছিলেন- সীমান্ত পার হলে কানাডিয়ানরা ফুলের মালা দিয়ে তাদের বরণ করবে।
লড়াইয়ের শুরুতে ডেট্রয়েট থেকে গভর্নর উইলিয়াম হাল (William Hull) কানাডায় হামলা চালান। খবর পেয়ে দলবল নিয়ে রওনা দেন স্যার আইজাক ব্রক, সঙ্গী হয় ইন্ডিয়ান মিত্ররা। তার মোকাবেলা না করে পিছিয়ে যান হাল। সুযোগ চিনতে ভুল করলেন না ব্রক। সোজা ডেট্রয়েটের দিকে যাত্রা করলেন তিনি, হুমকি দিলেন শহর সমর্পণ না করলে সর্বাত্মক আক্রমণের। বিনা যুদ্ধেই ১৬ আগস্ট দাবি মেনে নেন হাল। ফলে মিশিগান আর মিসিসিপির অঞ্চলে প্রবেশ করে ব্রিটিশরা।
মন্ট্রিয়ল বরাবর মার্কিনিদের অভিযানও ব্যর্থ হয়। নায়াগ্রা নদী পার হয়ে কানাডার কুইন্সটাউন আক্রমণ করেন স্টিফেন রেন্সলার (Stephen van Rensselaer)। এখানেও হাজির হন ব্রক, ঠেকিয়ে দেন শত্রুদের। তবে যুদ্ধে নিহত হন ব্রিটিশ মেজর জেনারেল। তবে এরপরেও নায়াগ্রা এলাকায় সুবিধে করতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র।
১৮১৩ সালে অবশ্য বেশ কিছু লড়াইয়ে জয় পায় মার্কিন সেনারা। ফলশ্রুতিতে ডেট্রয়েট ফিরিয়ে নিতে সক্ষম হয় যুক্তরাষ্ট্র। তৎকালীন ব্রিটিশ কানাডার রাজধানী ইয়র্ক (বর্তমান টরন্টো) চলে যায় তাদের হাতে। তবে মন্ট্রিয়ল দখল করতে গিয়ে আবারও পিছু হটতে বাধ্য হয় তারা। বছরের শেষদিকে ব্রিটিশ আর কানাডিয়ান সেনারা ইয়র্ক পুনর্দখল করে। পালিয়ে যাওয়ার সময় ইয়র্কসহ আশপাশের বেশ কিছু গ্রাম পুড়িয়ে দেয় শত্রুরা।

১৮১৪ সালে চূড়ান্ত পরাজয় হয় নেপোলিয়নের। ইউরোপ থেকে সেনা আর নৌবাহিনীর একাংশ উত্তর আমেরিকায় পাঠায় ব্রিটিশরা। চেসাপেক বে’তে (Chesapeake Bay) ঘাঁটি করে ওয়াশিংটন ডিসি আর বাল্টিমোরের দিকে নিশানা করে তারা। উদ্দেশ্য কানাডা থেকে আমেরিকান সেনাদের এদিকে সরিয়ে আনা।
২৪ আগস্ট মেরিল্যান্ডে সংঘটিত ব্ল্যাডেন্সবার্গের (Bladensburg) যুদ্ধে পরাস্ত হয় মার্কিনিরা। সেদিনই ওয়াশিংটন ডিসির পতন ঘটে জেনারেল রবার্ট রসের হাতে (Robert Ross)। প্রেসিডেন্ট ম্যাডিসন, ফার্স্ট লেডি ডলি ম্যাডিসন (Dolley Madison) এবং সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা পালিয়ে যান।
কানাডিয়ান আর ব্রিটিশ সেনারা ইয়র্ক পুড়িয়ে দেয়ার প্রতিশোধ তোলে কড়ায়-গন্ডায়। উচ্চপর্যায় থেকে নির্দেশ ছিল ব্যক্তিগত সম্পত্তির ক্ষতি করা যাবে না। তবে সরকারি ভবনের বেলায় নিষেধাজ্ঞা নেই। ক্যাপিটল বিল্ডিং, এক্সিকিউটিভ ম্যানশন (বর্তমান হোয়াইট হাউজ), লাইব্রেরি অব কংগ্রেস, কোষাগারসহ অন্যান্য বহু সরকারি দালান আগুনে ছারখার হয়ে যায়। পরদিন বৃষ্টি নামলে অবশ্য আগুন নিভে যায়।
তবে ব্রিটিশদের বাল্টিমোর অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এখানে জেনারেল রস নিহত হন। এরপর দুই পক্ষই বিক্ষিপ্তভাবে সংঘর্ষ চালিয়ে যায়, তবে কেউই চূড়ান্ত বিজয়ের দেখা পাচ্ছিল না।

ফ্রান্সের সাথে কয়েক দশক ব্যাপী যুদ্ধের পর ক্লান্ত ইংল্যান্ড চাচ্ছিল দ্রুত ঝামেলা মিটিয়ে ফেলতে। যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেও এই লড়াই নিয়ে অসন্তোষ ছিল। ফলে ১৮১৪ সালে বর্তমান বেলজিয়ামের ঘেন্ট শহরে আলোচনা আরম্ভ হয়। ডিসেম্বর মাসে চুক্তিতে (Treaty of Ghent) স্বাক্ষর করে দুই পক্ষ। যুদ্ধের পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরে যেতে রাজি হয় সবাই। তবে যেসব কারণে লড়াইয়ের সূচনা এর সুরাহা হয়নি চুক্তিতে। এজন্য কথাবার্তা জারি থাকে, এবং ধীরে ধীরে সমাধান হয় সমস্যার।
ঘেন্টের চুক্তির মাধ্যমে কানাডাতে টিকে যায় ব্রিটিশ আধিপত্য। আরো প্রায় অর্ধ শতাব্দী সেখানে জারি ছিল তাদের শাসন। যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসন সফলভাবে প্রতিহত করার মাধ্যমে উন্মেষ ঘটে কানাডার জাতীয়তাবাদী চেতনার। এর ফলশ্রুতিতে কালের পরিক্রমায় স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে কানাডার আত্মপ্রকাশের পথ প্রশস্ত হয়। তবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ইন্ডিয়ান আদিবাসীরা। ব্রিটিশদের সমর্থন ছাড়া অভিবাসীদের ঠেকানোর শক্তি ছিল না তাদের। ফলে কোণঠাসা হয়ে পড়ে তারা। বিপুল পরিমাণে জমি দখল করে নেয় অভিবাসীরা।