সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আন্দোলনের পটভূমিতে দেশে একের পর এক প্রশ্নবিদ্ধ মামলা দায়ের হচ্ছে। এসব মামলার অধিকাংশই হয়রানিমূলক, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং অনেকক্ষেত্রে কল্পিত। চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, অভিনয়শিল্পী থেকে শুরু করে সাধারণ পেশাজীবীরাও এসব মামলার শিকার হচ্ছেন।
ঢাকার পিজি হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. হাসানুল হক নিপুন শাহবাগ থানার একটি মামলায় বিনা প্রমাণে গ্রেপ্তার হয়ে ৫৫ দিন কারাগারে ছিলেন। মামলার বাদী ইসমাইল হোসেন এজাহারে শুধু ‘অজ্ঞাতনামা’ আসামিদের কথা উল্লেখ করেন। ডা. নিপুন জানান, তিনি ঘটনাস্থলে ছিলেন না এবং অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা।
চুয়াডাঙ্গার এক মামলায় ৬৯ জন পরিচিত ও ৮০-৯০ জন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। বাদী পরে আদালতে জানান, কিছু নাম ভুলে যুক্ত করা হয়েছে। তবে ততক্ষণে নিরপরাধ অনেকেই হয়রানির শিকার হন।
কক্সবাজারের ইমরান তৌহিদ রানাকে সৌদি যাওয়ার আগে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তার নামে মামলা আছে জানিয়ে পুলিশ ঘুষ দাবি করে। পরিবারের সদস্যরা দুটি গরু বিক্রি করে অর্থ জোগালেও, তাকে মিথ্যা মামলায় জেলহাজতে পাঠানো হয়। এতে তার বিদেশযাত্রা স্থগিত হয় এবং শুরু হয় এনজিও কিস্তির বোঝা।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায়ও মানুষ মামলার আসামি হচ্ছেন। যেমন—নৃত্যশিল্পী শোভন সাহা বা অস্ত্রোপচারে ব্যস্ত সাবেক কাউন্সিলর লিয়াকত হোসেন। নরসিংদীর ফরেজ আলী কর্মস্থলে বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা গেলেও তাকে ‘হত্যাকাণ্ডের শহীদ’ বলা হয় এবং মামলা হয় ১৭৬ জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে।
রাউজানে যুবদলকর্মী ইব্রাহিম হত্যাকাণ্ডে এক পত্রিকার সম্পাদক ও ব্যবসায়ীকে রহস্যজনকভাবে আসামি করা হয়। অভিযোগ, প্রকৃত আসামিদের আড়াল করতেই এমনটা করা হয়েছে।
প্রবাসী আমির হোসেন দেশে ফিরে জানতে পারেন, তার নাম একটি মামলায় যুক্ত। মামলার নাম বাদ দিতে চক্রটি তার কাছে পাঁচ কোটি টাকা দাবি করে।
ঢাকার বিভিন্ন থানায় অনুসন্ধানে দেখা যায়, অনেক বাদী নিজেরাও জানেন না মামলা কাদের বিরুদ্ধে করা হয়েছে। অনেকেই পুলিশের সহযোগিতায় আদালতে হলফনামা দিয়ে অর্থের বিনিময়ে নাম বাদ দেন। এমনকি চলচ্চিত্র তারকারাও বাদ যাননি—নুসরাত ফারিয়া, অপু বিশ্বাস, নিপুণ, ভাবনা, জায়েদ খানসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে ভাটারা থানায় হত্যা চেষ্টার মামলা করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব মামলার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছাড়াও চলছে বড় অঙ্কের বাণিজ্য। রাজনৈতিক নেতা, অসাধু পুলিশ সদস্য, আইনজীবী ও দালালদের নিয়ে গড়ে উঠেছে মামলাবাণিজ্য চক্র। মামলায় নাম যোগ বা বাদ দেওয়ার বিনিময়ে আদায় করা হচ্ছে লাখ লাখ টাকা।
তদন্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ৫ আগস্টের ঘটনার পর অনেক মামলার তদন্তে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে, কারণ অনেক অভিযোগ অস্পষ্ট ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন অসম্পূর্ণ। অধিকাংশ মামলায় ‘হুকুমদাতা’র নাম থাকলেও কার নির্দেশে কীভাবে ঘটনা ঘটেছে, তা স্পষ্ট নয়।
ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী জানান, মামলাবাণিজ্যে জড়িতদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।