Ridge Bangla

প্রাণ: বাংলাদেশি ব্র্যান্ড যেভাবে ছড়িয়ে গেল গোটা বিশ্বে

পৃথিবীর সব দেশেই লম্বা কর্মজীবনের পর অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা জীবনের বাকি সময় নিজের মতো করে উপভোগ করেন। কর্মজীবনে সাধারণত অনেক নিয়মকানুন মেনে চলতো হতো। অবসরজীবনে তাদের আর সেসব মানার কোনো বাধ্যবাধকতা থাকে না। শান্তিময় একটা জীবনযাপন করাই তখন মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে।

অনেকে এই সময়ে ভ্রমণে বের হন, কেউ কেউ নিজের নানা শখ পূরণে সময় বিনিয়োগ করেন, অনেকে আবার পরিবারকে সময় দিতে শুরু করেন। বিশেষ করে প্রতিরক্ষা বাহিনীর নিয়মকানুনে বাধা জীবন অতিক্রম করে অবসর-পরবর্তী সময় যেন রীতিমতো আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু অবসরের পর আরামের জীবনের পরিবর্তে একজন বাংলাদেশি বেছে নিলেন অন্য এক জীবন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল পদ থেকে অবসরে যাওয়ার পর আমজাদ খান চৌধুরী সিদ্ধান্ত নিলেন তার স্বপ্নের পেছনে ছুটবেন।

সাবেক মেজর জেনারেল আমজাদ হোসেন চৌধুরী দেখলেন- বাংলাদেশের কৃষকদের সেচ প্রদানে বেশ অসুবিধা পোহাতে হচ্ছে। বলা বাহুল্য, তখন দেশের অর্থনীতি অনেকাংশে নির্ভর করত কৃষির উপর। কৃষি আক্ষরিক অর্থেই ছিল আমাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। আমজাদ খান চৌধুরী জমিতে সেচ প্রদান আরও সহজ করে তোলার জন্য ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘রংপুর ফাউন্ড্রি লিমিটেড’ (Rangpur Foundry Limited) বা ‘আরএফএল’।

এই কোম্পানির মূল লক্ষ্য ছিল ঢালাই লোহার মাধ্যমে সেচ পাম্প তৈরি করা এবং মূল্য এমন পর্যায়ে রাখা যাতে কৃষকেরা সহজেই তা কিনতে পারে। কিন্তু এখানেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাইলেন না তিনি। বাংলাদেশের কৃষিখাত নিয়ে আরও বিশদ পরিকল্পনা ছিল তার। সেগুলো বাস্তবায়নের নির্দিষ্ট রূপরেখাও তৈরি করেছিলেন তিনি।

আরএফএল প্রতিষ্ঠা করার চার বছর পর, অর্থাৎ ১৯৮৫ সালে তিনি নতুন এক পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসরের সিদ্ধান্ত নিলেন। নরসিংদীতে ছয় একর জমির চুক্তি নিয়ে সেখানে কৃষিপণ্য উৎপাদন শুরু করলেন তিনি। প্রাথমিকভাবে পেপে, কলা, আনারস ও আরও কিছু ফল চাষ করা হলো। তরতাজা অবস্থায়ই বাজারজাত করলেন। কিন্তু ভাগ্য সহায় হলো না।

তিনি দেখলেন, ভালো মতো উৎপাদন করে ভোক্তাদের হাতে টাটকা পৌঁছে দেয়ার পরও উপযুক্ত মূল্য পাওয়া যাচ্ছে না। এবার তার মাথায় আরেকটি পরিকল্পনা আসল। তিনি দেখলেন, কৃষিপণ্য সরাসরি বাজারজাত করে উপযুক্ত মূল্য সবসময় পাওয়া না গেলেও প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে সেসব থেকে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করলে সেগুলো বাজারে ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনার সম্ভাবনা রয়েছে। এই চিন্তা থেকেই ১৯৯১ সালে জন্ম নিল ‘প্রাণ’ (Pran), যেটি পরবর্তীতে বাংলাদেশের গন্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ল ১৪০টিরও বেশি দেশে।

শুরুতে আনারস কেটে প্রক্রিয়াজাত করে ক্যানে সংরক্ষণ করে বাজারে আনা হয়। কিন্তু তার পরিকল্পনা ছিল দেশীয় বাজারের পাশাপাশি অন্যান্য দেশের বাজারেও প্রাণের কৃষিজাত খাদ্যপণ্যের প্রসার ঘটানোর। প্রাণের প্রতিষ্ঠাতা আমজাদ খানের স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশের কৃষকদের উৎপাদিত খাদ্য ইউরোপের টেবিলে পরিবেশিত হবে। প্রাণ প্রতিষ্ঠার মাত্র ছয় বছরের মাথায় তার এই স্বপ্ন পূরণ হয়।

১৯৯৭ সালে ফ্রান্সে প্রথমবারের মতো পণ্য রপ্তানি করে প্রাণ। আচার, আনারস ও মুড়িসহ প্রায় এগারো হাজার ডলারের পণ্য রপ্তানি করা হয় দেশটিতে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পণ্যের গুণগত মান ভালো থাকায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাজারে প্রাণ পণ্য রপ্তানি করতে শুরু করে এবং সাফল্যের মুখ দেখে। ইউরোপ তো বটেই, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকাতেও প্রাণের পণ্য পৌঁছে যায়।

বর্তমানে বিশ্বের ১৪৫টি দেশে প্রাণের খাদ্যপণ্য রপ্তানি হচ্ছে। রপ্তানি করা হয় এরকম প্রায় দেড়শো রকমের পণ্যের মধ্যে রয়েছে জ্যুস, বিস্কুট, মশলা, জেলি, চকলেটসহ আরও অনেক ধরনের পণ্য। প্রাণের সবচেয়ে বড় বাজার ভারত। ১৯৯৭ সালে ভারতের ত্রিপুরায় প্রথমবারের মতো চানাচুর রপ্তানি করা হয়। এখানেও সাফল্যের মুখ দেখে প্রাণ। খুব দ্রতই ভারতে প্রাণের পণ্যের চাহিদা বাড়তে থাকে। ভারতের ২৮টি রাজ্যের মধ্যে ২৫টিতেই প্রাণ্যের পণ্য রপ্তানি করা হচ্ছে বর্তমানে। এছাড়াও ভারতে তাদের রপ্তানির হার প্রতি বছর দশ শতাংশ করে বাড়ছে।

ভারত ও নেপাল– দুটি দেশেই প্রাণের ফ্যাক্টরি রয়েছে। ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাজারে আম থেকে উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্যের বড় সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করেন প্রাণের বর্তমান প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আহসান খান চৌধুরী। প্রতিবছর প্রাণের সর্বমোট বিক্রয় ছাড়ায় দুই বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে বিদেশ থেকে প্রায় প্রায় তিনশো মিলিয়ন ডলার আয় করে প্রতিষ্ঠানটি।

প্রাণ দেশের সর্ববৃহৎ কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান। বেকারত্ব যেখানে আমাদের একটি বড় সমস্যা, সেখানে অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ধারণা করা হয়, প্রাণের সাথে চুক্তিবদ্ধ কৃষকের সংখ্যা এক লাখেরও বেশি। বিশ্বের অনেক বাজারেই বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে প্রতিষ্ঠানটি। দেশীয় বাজারেও প্রাণ নিজেদের অনন্য অবস্থান তৈরিতে সক্ষম হয়েছে।

তথ্যসূত্র

১) A Brief History of PRAN – Future Startup

২) In memory of the man who built Pran – The Daily Star

৩) History Overseas – Pran Foods

আরো পড়ুন