Ridge Bangla

গোবেকলি তেপে: স্টোনহেঞ্জেরও পুরোনো এক রহস্যময় প্রাচীন কীর্তি

আজ থেকে প্রায় ১১,০০০ বছর পূর্বে, যখন মানুষ কৃষিকাজ বা গৃহপালিত প্রাণী সম্পর্কে কিছু জানত না, তখন একদল শিকারি-সংগ্রাহী পৃথিবীর বুকে গড়ে তোলে এক বিস্ময়কর প্রস্তর স্থাপনা। স্থানটির নাম গোবেকলি তেপে। আধুনিক তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে, উঁচু পাহাড়চূড়ায় অবস্থিত এই নিওলিথিক নিদর্শনটির নামের অর্থ ‘উঁচু পেটের ঢিবি’। কেউ কেউ একে বাইবেলের আদিপর্বের সেই গার্ডেন অব ইডেনের আসল অবস্থান বলেও দাবি করেন।

দীর্ঘকাল ধরে গারমুশ পর্বতমালার গভীরে চাপা পড়ে থাকা গোবেকলি তেপের অস্তিত্ব প্রথম জানা যায় ১৯৬০-এর দশকে। তবে তখনকার প্রত্নতাত্ত্বিকেরা এ স্থানকে বিশেষ গুরুত্ব দেননি। ১৯৯৪ সালে জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদ ক্লাউস শ্মিট এলাকাটি ঘুরে দেখলে পালটে যায় দৃশ্যপট। এক বছর পর খনন শুরু হলে চমকে ওঠেন গবেষকরা।

এ পর্যন্ত এখানে যে ৪৩টি স্তম্ভ আবিষ্কৃত হয়েছে, সেগুলো মূলত নরম চুনাপাথরে নির্মিত। পাথরের হাতুড়ি, আগ্নেয় পাথরের ফলক, যেগুলোর অধিকাংশই খননকালে খুঁজে পাওয়া গেছে। শুধু স্তম্ভ নয়, পুরো গোবেকলি তেপে গঠিত হয়েছে বিশাল বৃত্তাকার প্রাঙ্গণ, বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা ও ছোট ছোট স্থাপনার সমন্বয়ে। ‘টি’-আকৃতির এই স্তম্ভগুলো উচ্চতায় প্রায় ১৮ ফুট এবং ৫০ টন ওজনের পর্যন্ত হয়ে থাকে। ধারণা করা হয়, এখনো মাটির নিচে প্রায় ২৫০টি স্তম্ভ লুকিয়ে রয়েছে। অনেক স্তম্ভতে চমকপ্রদ শৈলীতে খোদাই করা আছে নানা জীবজন্তুর চিত্র। যেমন- সিংহ, ষাঁড়, বিছে, সাপ, বুনো শূকর, শকুন, জলচর পাখি, পতঙ্গ ও মাকড়সা। কারও কারও মতে, এখানে চলত পশুবলি কিংবা মৃত্যুপূজার আচার। এখানে শেয়ালের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য। অনেক স্তম্ভেই শেয়ালের প্রতিকৃতি এবং খননের সময় বারবার পাওয়া গেছে শেয়ালের হাড় ও দেহাবশেষ। এতে সন্দেহ জাগে, গোবেকলি তেপে নির্মাণকারী জনগোষ্ঠী হয়ত শেয়ালকে পূজ্য প্রাণী হিসেবে ভাবত।

গোবেকেলি তেপে: Image source: UNESCO World Heritage Centre

গোবেকেলি তেপের নির্মাণ রহস্য আরও একটি প্রশ্ন জাগায় মনে। তা হলো, এই বিপুল প্রস্তর কাঠামো আসলে কী উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল?

গবেষকদের একাংশ মনে করেন, এটি হতে পারে কোনো ধর্মীয় বা আচারিক সমাবেশস্থল, যেখানে শিকারি-সংগ্রাহকেরা সময়বিশেষে একত্রিত হতেন। প্রাচীন এই জনগোষ্ঠী হয়তো বিশ্বাস করতেন, প্রতিটি প্রাণী, উদ্ভিদ, এমনকি জড়বস্তুর মধ্যেও আত্মা রয়েছে। তাই এই স্থাপনা হয়তো ছিল এমন এক পবিত্র পরিসর, যেখানে বিভিন্ন গোষ্ঠী এসে তাদের বিশ্বাস ও সংস্কার পালনের সুযোগ পেতেন।

গত তিন দশকের খননে স্পষ্ট হয়েছে, এই স্থান যারা নির্মাণ করেছে, তারা তখনো কৃষিকাজ শেখেনি। তাদের জীবনচর্চা ছিল শিকার ও সংগ্রহকেন্দ্রিক। এতদিন ধারণা ছিল, কৃষির আবিষ্কার এবং গ্রামীণ বসতির উত্থানই সভ্যতার সূচনা ঘটায়। কিন্তু শ্মিট বলেছিলেন, এই ক্ষেত্রে উল্টোটি ঘটেছে। ধর্মীয় প্রয়োজনে গোবেকলি তেপের মতো বিশাল নির্মাণই মানুষকে বসতির দিকে ঠেলে দেয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, ধর্ম নয়, সভ্যতার প্রথম চালিকাশক্তি হলো বিশ্বাস।

Image Source: irmikbune

আশপাশের বিভিন্ন জায়গায় অনুসন্ধান চালিয়ে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা এমন এক প্রাগৈতিহাসিক গ্রামের সন্ধান পেয়েছেন, যা গোবেকলি তেপে থেকে মাত্র ২০ মাইল দূরে অবস্থিত। সেখানেই মেলে বিশ্বের প্রাচীনতম গৃহপালিত গমের প্রমাণ। রেডিও-কার্বন পরীক্ষায় দেখা যায়, এই এলাকায় কৃষির জন্ম গোবেকলি তেপে নির্মাণের মাত্র কয়েকশো বছরের মধ্যেই, প্রায় ১০,৫০০ বছর আগে। আর গবাদিপশু — যেমন ভেড়া, গরু ও শুকরের গৃহপালন শুরু হয় গোবেকলি তেপের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের প্রায় হাজার বছর পর। এসব তথ্য-প্রমাণ থেকে স্পষ্ট হয়, এই অঞ্চলটি কৃষিবিপ্লবেরও এক অগ্রগামী

কেন্দ্র ছিল। গোবেকলি তেপের মতো বিশাল একটি স্থাপনা নির্মাণে যে পরিমাণ পরিকল্পনা, শ্রম আর সম্পদের প্রয়োজন, তা শিকারি-সংগ্রাহক সমাজের জন্য একেবারেই অকল্পনীয় ছিল।

তবে এই বিশাল পাথুরে স্থাপনাগুলোর প্রকৃত উদ্দেশ্য আজও ধাঁধার মতো। কেনই বা শিকারি সমাজ এমন জটিল ও শ্রমসাধ্য নির্মাণকাজে হাত দিল? স্মিট মনে করেন, এই স্থানটি ছিল মৃতদের উপাসনা বা ‘কাল্ট অব দ্য ডেড’-এর কেন্দ্রবিন্দু। এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট কবর আবিষ্কৃত না হলেও তিনি বিশ্বাস করেন, এই বৃত্তাকার স্থাপনাগুলোর মেঝের নিচেই হয়তো কোনো একদিন মিলবে প্রাচীন কালের কোনো গোপন সমাধি।

The Vulture Stone. Credit: Alistair Coombs
Image source: Alistair Coombs

গবেষকদের মতে, গোবেকলি তেপের স্তম্ভগুলোর বিন্যাস নক্ষত্রপুঞ্জ সিরিয়াস ও অরিয়নের অবস্থানের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। এটি ইঙ্গিত করে, ওই যুগের যুগের মানুষ হয়তো আকাশ ও মহাজগত নিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণ করত।

প্রায় ৮,০০০ বছর আগে গোবেকলি তেপে মাটি, পাথর ও বর্জ্য দিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে চাপা দেওয়া হয়। কেন এই স্থাপনাটি এত যত্ন করে ঢেকে রাখা হয়েছিল, তা আজও একটি রহস্য।

স্তম্ভগুলোতে এমন অনেক প্রাণীর চিত্র পাওয়া গেছে, যেমন চিতা, বিশাল পাখি ও অজানা প্রাণী, যেগুলোকে এখন আর ঐ অঞ্চলে দেখা যায় না। অনেকগুলোর অস্তিত্ব পৃথিবীতেই নেই এখন। এগুলোর মধ্যে কিছু হয়ত আদিম লোককথা বা ধর্মীয় বিশ্বাসে থাকা প্রতীকী প্রাণী।

এই সব নিদর্শন প্রমাণ করে, প্রাক-ইতিহাস মানে শুধু আধুনিকতার সূচনা নয়। বরং, ইতিহাসের বাইরেও ইতিহাসের অস্তিত্ব রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, কীভাবে ইতিহাসের চেয়ে বস্তু ও স্থাপত্য আরও গভীর সত্য বলি দেয়? গোবেকলি তেপে আমাদের বাধ্য করে সেই প্রশ্ন করতে, যা ইতিহাস বইয়ে লেখা নেই।

তথ্যসূত্র:
  1. Curry, A. (2008). Gobekli Tepe: The world’s first temple. Smithsonian Magazine, 3, 1-4.
  2. Dietrich, O., Heun, M., Notroff, J., Schmidt, K., & Zarnkow, M. (2012). The role of cult and feasting in the emergence of Neolithic communities. New evidence from Göbekli Tepe, south-eastern Turkey. Antiquity, 86(333), 674-695.
  3. Gobekli Tepe: The World’s First Temple? – Smithsonian Magazine
  4. The Birth of Religion – National Geographic
  5. The Göbekli Tepe Ruins and the Origins of Neolithic Religion

আরো পড়ুন