বিশ্বজুড়ে মহাসাগর এখন এক গভীর সংকটে। জাতিসংঘ এই পরিস্থিতিকে ‘জরুরি অবস্থা’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। এই সংকট মোকাবিলায় ফ্রান্সের নিস শহরে শুরু হচ্ছে বহুল প্রতীক্ষিত জাতিসংঘ মহাসাগর সম্মেলন। সোমবার থেকে শুরু হওয়া এই সম্মেলনে প্রশ্ন উঠেছে—এবারও কি কেবল কথার ফুলঝুরি হবে, নাকি সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আসবে বাস্তব পদক্ষেপ?
সংরক্ষিত সামুদ্রিক এলাকা
সম্মেলনে সম্ভাবনা রয়েছে, কিছু দেশ নতুন সামুদ্রিক সংরক্ষণ এলাকা ঘোষণা করতে পারে। তবে এই অঞ্চলগুলো বাস্তবে কতটা সুরক্ষিত থাকবে, তা নিয়ে রয়ে গেছে নানা প্রশ্ন। অনেক দেশেই সংরক্ষিত এলাকায় স্পষ্ট নীতিমালার অভাব রয়েছে। যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ফ্রান্সসহ অনেক দেশেই ‘সংরক্ষিত’ বললেও সেখানে বটম ট্রলিংয়ের মতো ধ্বংসাত্মক মাছ ধরার পদ্ধতি অনুমোদিত। এর ফলে বাস্তবে মাত্র ৩ শতাংশ মহাসাগরই প্রকৃত অর্থে শোষণমুক্ত। অথচ বৈশ্বিক লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে অন্তত ৩০ শতাংশ মহাসাগর সুরক্ষিত করা।
উন্মুক্ত সমুদ্র ও চুক্তির বাস্তবায়ন
এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে ২০২৩ সালে স্বাক্ষরিত উন্মুক্ত সমুদ্র সুরক্ষা চুক্তির কার্যকারিতা অপরিহার্য। কিন্তু এই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন ৬০টি দেশের অনুমোদন, যেখানে এখনো অর্ধেকের মতো দেশ সায় দেয়নি। সম্মেলনের আগে ফ্রান্স এই সংখ্যা পূরণের চেষ্টা করলেও এখনো তা সফল হয়নি।
অজানা গভীরের খনন
সমুদ্রতলের খনিজ সম্পদ আহরণ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। এখন পর্যন্ত ৩৩টি দেশ গভীর সমুদ্র খননের বিরোধিতা করে সাময়িক স্থগিতাদেশ চেয়েছে। ফ্রান্স এই সংখ্যা আরও বাড়াতে চায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, পর্যাপ্ত গবেষণা ছাড়া খনন কার্যক্রম শুরু করা হলে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ওপর চরম বিপর্যয় নেমে আসবে। এ বিষয়টি আগামী জুলাইয়ে আন্তর্জাতিক সমুদ্রতল কর্তৃপক্ষ (ISA)-এর বৈঠকে গুরুত্ব পাবে, যেখানে গভীর সমুদ্র খননের আন্তর্জাতিক নীতিমালা নির্ধারণ করা হবে।
শুধু কথা নয়, চাই বাস্তব পদক্ষেপ
সম্মেলন শেষে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো একটি রাজনৈতিক ঘোষণাপত্র গ্রহণ করবে, যাতে সমুদ্র সংকট মোকাবিলায় সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি থাকবে। তবে অনেকেই বলছেন, আট পৃষ্ঠার এই খসড়া ঘোষণাপত্র দুর্বল ভাষায় রচিত এবং জ্বালানি খাতের ভূমিকা যথাযথভাবে তুলে ধরা হয়নি। নরওয়ের মেরিন রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নীতি নির্ধারক পিটার হাউগানের মতে, ঘোষণাপত্রের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো দেশগুলোর স্বতন্ত্র প্রতিশ্রুতি ও বাস্তব পদক্ষেপ।
অর্থই বড় প্রশ্ন
সমুদ্র সংরক্ষণে বিনিয়োগ ঘাটতি দীর্ঘদিনের। যেহেতু এই সম্মেলন কোনো জলবায়ু সম্মেলন বা বাধ্যতামূলক আইনি কাঠামো নয়, তাই আর্থিক প্রতিশ্রুতি দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়। তবু প্রত্যাশা রয়ে গেছে যে, দেশগুলো অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সংরক্ষণের পথকে মজবুত করবে। বিশ্ব প্রকৃতি সংরক্ষণ তহবিলের (WWF) পাউলি মেরিম্যান বলেন, “আমরা এখনো যে তিনটি বিষয়ে ঘাটতি দেখছি তা হলো—দৃঢ় সংকল্প, পর্যাপ্ত অর্থ এবং বাস্তবায়ন। শুধু সদিচ্ছা নিয়ে নিসে সম্মেলনে আসা যথেষ্ট নয়।”