দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন চারদিকে সংঘাতের দাবানল ছড়িয়ে দিল, তখন যুদ্ধরত দেশগুলোও আধুনিকতর যানবাহন, অস্ত্র, উপকরণ ও ওষুধ আবিষ্কারের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ল। জীবন-মৃত্যুর এই সন্ধিক্ষণ উদ্ভাবকদেরও তাড়িত করল নতুন নতুন প্রযুক্তি তৈরি করতে। সেসময় আবিষ্কৃত কিছু প্রযুক্তি বদলে দিয়েছিল যুদ্ধ ও সভ্যতার রূপ। এখানে তুলে ধরা হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছু গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের গল্প।
জিপ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এক সামরিক যান তৈরির জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে মার্কিন সেনাবাহিনী। তারা দেশটির গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে নতুন ডিজাইন চেয়ে চিঠি পাঠায়। শর্ত ছিল- যানটি হতে হবে হালকা ও সহজে নিয়ন্ত্রণযোগ্য, অন্তত তিনজন সৈন্য বহনে সক্ষম, এবং বন্ধুর পথেও যাতে চলতে পারে। শেষ পর্যন্ত কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ডিজাইন মিলিয়ে তৈরি করা হয় চূড়ান্ত মডেল। সম্মিলিতভাবে কয়েকটি কোম্পানি এই নতুন সামরিক যান উৎপাদন শুরু করে। ১৯৪০ সালে প্রথমবারের মতো রণক্ষেত্রে দেখা মেলে এই বাহনের। সৈনিকরা আদর করে একে ‘জিপ’ নামে ডাকতে শুরু করে, আর ধীরে ধীরে এই নামই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
সুপারগ্লু

১৯৪২ সালে ড. হ্যারি কুভার নতুন ধরনের স্বচ্ছ বন্দুকের লেন্স তৈরির চেষ্টা করছিলেন। গবেষণাগারে তিনি সায়ানোঅ্যাক্রিলেট নামের রাসায়নিক যৌগ পরীক্ষা করছিলেন, কিন্তু এর তীব্র আঠালো বৈশিষ্ট্যের কারণে সেটি বাতিল করে দেন। তবে, পরবর্তী সময়ে এটি অন্য ক্ষেত্রে দারুণ উপযোগী হয়ে ওঠে এবং ‘সুপারগ্লু’ নামে পরিচিতি পায়। এরপর স্প্রে-আকারে সুপারগ্লুর ব্যাপক উৎপাদন শুরু হয়।
জেট ইঞ্জিন

১৯৩৯ সালের ২৭ আগস্ট, জার্মানির আকাশে ওড়ে ‘হেইঙ্কেল হে ১৭৮’ বিমান। এটি ছিল ইতিহাসের প্রথম সফল টার্বোজেট ফ্লাইট। এরপর ১৯৪১ সালের ১৫ মে, ব্রিটিশরা ইংল্যান্ডের লিংকনশায়ারের আরএএফ ক্রানওয়েল ঘাঁটির আকাশে তাদের প্রথম টার্বোজেটচালিত বিমান উড়িয়ে এর জবাব দেয়। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোড় ঘোরাতে জেট বিমান বড় কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি, তবে পরবর্তী সময়ে যুদ্ধ ও বাণিজ্যিক পরিবহনের জগতে এটি এক অবিস্মরণীয় পরিবর্তন নিয়ে আসে।
সিন্থেটিক রাবার

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধজুড়ে রাবার ছিল সামরিক কার্যক্রমের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যানবাহনের টায়ার, যন্ত্রপাতির বিভিন্ন অংশ, সৈন্যদের জুতা, পোশাক ও সরঞ্জামে রাবারের ব্যবহার ছিল অপরিহার্য। ১৯৪২ সালে জাপান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাবার উৎপাদন কেন্দ্রগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয়। ফলে মিত্রশক্তির সামনে এক বড় সংকট দেখা দেয়। তখন মার্কিন বিজ্ঞানীরা বিকল্প সন্ধানে নেমে পড়েন। এর আগেই তারা প্রাকৃতিক রাবারের পরিবর্তে সিন্থেটিক রাবার তৈরির গবেষণা করছিলেন। কিন্তু এবার তা দ্রুত বাণিজ্যিক উৎপাদনে রূপ দেন। এরপর আমেরিকাজুড়ে ডজনখানেক সিন্থেটিক রাবার কারখানা চালু করা হয়, আর ১৯৪৪ সালের মধ্যে এসব কারখানা ৮ লক্ষ টন সিন্থেটিক রাবার উৎপাদন করে।
পারমাণবিক বোমা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রকল্প ছিল এক বিশাল প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক উদ্যোগ। এতে অংশ নেয় প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার বিজ্ঞানী ও শ্রমিক; প্রয়োজন হয় কয়েক টন ইউরেনিয়াম আকরিক, অত্যাধুনিক গবেষণাগার এবং ২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থায়ন। এর ফলস্বরূপ জন্ম নেয় এক পারমাণবিক বোমা। ১৯৪৫ সালে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে এই ভয়ংকর অস্ত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে জাপান আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটায়।
রাডার

যদিও রাডার প্রযুক্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই ব্যবহৃত হচ্ছিল, তবে যুদ্ধের সময় এটি ব্যাপক উন্নতি লাভ করে। যুদ্ধের আগে ব্রিটেনের দক্ষিণ ও পূর্ব উপকূলে রাডার স্থাপন করা হয়। ১৯৪০ সালে ব্যাটল অব ব্রিটেনের সময়, এই প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্রিটিশ সেনারা আগাম সতর্কবার্তা পায়, যা জার্মান হামলা প্রতিহত করতে সহায়তা করে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির বিজ্ঞানীরা রাডারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেন। তারা শত্রুপক্ষের বিমানে তীব্র তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ পাঠিয়ে পাইলটদের আহত করার পরিকল্পনা করলেও তাতে সফল হননি। তবে, যুদ্ধজুড়ে শত্রুর উপস্থিতি শনাক্ত করতে রাডার এক অনন্য প্রযুক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
মাইক্রোওয়েভ ওভেন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রাডার প্রযুক্তির অন্যতম উদ্ভাবক পার্সি স্পেন্সার, যুদ্ধের পর এই প্রযুক্তিকে ভিন্নভাবে কাজে লাগান। একদিন তিনি রাডার পরীক্ষা করার সময় দেখেন, তাঁর পকেটে রাখা চকলেট গলে গেছে। কৌতূহলী হয়ে তিনি বিভিন্ন খাবারের ওপর পরীক্ষা চালান এবং স্বল্পতরঙ্গের রেডিও তরঙ্গ মাইক্রোওয়েভ ব্যবহারের সম্ভাবনা খুঁজে পান। এরপর, দ্রুতই মাইক্রোওয়েভ ওভেনের জন্ম হয়।
ইলেকট্রনিক কম্পিউটার

কলসাস নামে প্রথম ইলেকট্রনিক কম্পিউটার আবিষ্কৃত হয় ব্রিটেনের ব্লেচলি পার্কে, যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কোড ভাঙার কাজ চলছিল। এটি তৈরি করা হয়েছিল নাৎসি বাহিনীর লরেঞ্জ কোড ডিকোড করার জন্য। অন্যদিকে, ১৯৪৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি হয় বিশ্বের প্রথম সাধারণ ব্যবহারযোগ্য ইলেকট্রনিক কম্পিউটার ENIAC। এটি মার্কিন সেনাবাহিনীর আর্টিলারি ফায়ারিং ডাটা গণনার কাজে ব্যবহৃত হত।
পেনিসিলিন

স্কটিশ বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ফ্লেমিং ১৯২৮ সালে পেনিসিলিন আবিষ্কার করেন। তবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করে এবং প্রচুর পরিমাণে এর উৎপাদন শুরু হয়। যুদ্ধে এটি অমূল্য জীবনরক্ষাকারী ওষুধে পরিণত হয়। আহত সৈন্যদের মধ্যে সংক্রমণ প্রতিরোধে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং তাদের বেঁচে থাকার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে তোলে। ১৯৪৪ সালে নরম্যান্ডি অভিযানের প্রস্তুতির সময়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুই মিলিয়ন ডোজেরও অধিক পেনিসিলিন তৈরি করে।