আমরা আরো চার বছরের জন্য জিততে যাচ্ছি। এরপর আমরা আরো চার বছরের জন্য লড়ব। কারণ, তারা আমাদের ক্যাম্পেইনে আড়ি পেতেছে। এর জন্য আমাদের আরো চার বছর পাওনা আছে।
– ২০২০ সালের আগস্টে উইসকনসিনে নির্বাচনী প্রচারণায় ডোনাল্ড ট্রাম্প
যদি আমাদের কাছে বিষয়টা খুব পছন্দনীয় হয় এবং পরিস্থিতি যদি এমনই থাকে, আমরা অতিরিক্ত এক বা দুই মেয়াদের জন্য লড়তে পারি।
– ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে নেভাডায় নির্বাচনী প্রচারণায় ডোনাল্ড ট্রাম্প
কিছুদিন আগেই মার্কিন গণমাধ্যম এনবিসিকে এক টেলিফোন সাক্ষাৎকারে ডোনাল্ড ট্রাম্প তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছেন। যদিও তার এই ধরনের আলাপ নতুন কিছু নয়।
উপরের দুই ঘটনা ছাড়াও ২০১৮ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যখন আইন পরিবর্তন করে কার্যত আজীবন নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে রাখার বন্দোবস্ত করেন, তখন ট্রাম্প তার ফ্লোরিডার রিসোর্ট মার-এ-লাগোতে এক ফান্ড রেইজার অনুষ্ঠানে এই প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “সম্ভবত আমরাও একদিন এমন চেষ্টা করব।”

তৃতীয় মেয়াদে আসতে হলে তাকে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান লঙ্ঘন করে আসতে হবে। ২২ তম সংশোধনী অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থাকতে পারবেন না। এই কারণে অতীতে তিনি এমন বক্তব্য দিলেও সবাই মজা হিসেবে দেখেছেন। তবে এবার এনবিসিকে তিনি নিশ্চিত করেছেন, তিনি মোটেও ‘মজা করছেন না’। তিনি সত্যি সত্যিই এটা নিয়ে ভাবছেন, যদিও ঠিক কোন প্রক্রিয়ায় তৃতীয় মেয়াদে আসবেন সেটার উত্তর দেননি। তিনি তার সমর্থক আর অনুসারীদের ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, অনেক মানুষই তাকে তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চায়। আবার এটাও জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে তার কাছে বর্তমান মেয়াদের কার্যক্রমই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
সম্প্রতি টেনেসির রিপাবলিকান প্রতিনিধি এন্ডি ওগোলস বিল উপস্থাপন করেছেন প্রেসিডেন্টের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য, যেন ডোনাল্ড ট্রাম্প আরেক মেয়াদের জন্য লড়তে পারেন। ট্রাম্পের আরেক ঘনিষ্ঠ মিত্র স্টিভ ব্যানন নিউজ ন্যাশনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২০২৮ সালের নির্বাচনে লড়বেন এবং আবার জয়ী হবেন।” তিনি আরো যোগ করেন, তারা এখনো এর বিস্তারিত নিয়ে ‘জনসম্মুখে’ কথা বলার জন্য প্রস্তুত না।
সুতরাং, ট্রাম্পের তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার বিষয়টি এখন কেবল হাস্যরসে সীমাবদ্ধ নেই। তাহলে তিনি কীভাবে তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসতে পারেন? আদৌ কি আসতে পারবেন?
ট্রাম্পের এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা দেশটির সংবিধানের ২২ তম সংশোধনী, যেটা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। ফ্রাংকলিন ডি রুজভেল্টের আগে ১৫০ বছরের বেশি সময় ধরে আমেরিকান প্রেসিডেন্টরা দুই মেয়াদের বেশি কেউই থাকেননি। জর্জ ওয়াশিংটনের সময় থেকে সবাই এই ঐতিহ্য বজায় রেখে চলতেন, যদিও তখন আইনি কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। কিন্তু রুজভেল্ট ১৯৩৩ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত চারবার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তারপর আমেরিকান আইনপ্রণেতারা ১৯৫১ সালে ২২ তম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বাধ্যবাধকতা নিয়ে আসেন যে কোনো ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারবেন না। তারপর থেকে দুই মেয়াদের বেশি কোনো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়েননি।

কিন্তু ট্রাম্প সমর্থকরা এখানে আইনের ফাঁক খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। ২০২৮ সালের নির্বাচনে তিনি ‘ভাইস প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে নির্বাচনে দাঁড়াতে পারেন। বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স যদি ২০২৮ এর নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন এবং নির্বাচিত হওয়ার পর ট্রাম্পের হাতে প্রেসিডেন্সির ভার ছেড়ে দেন, তাহলে সেরকম পরিস্থিতিতে ট্রাম্প তৃতীয় মেয়াদে আসতে পারেন। এনবিসিকে ট্রাম্প জানিয়েছেন, এটা একটা উপায় হতে পারে, তবে আরো উপায় আছে। যদিও সেটা কী তিনি বলেননি।
তবে এক্ষেত্রে তার বাধা হবে সংবিধানের ১২ তম সংশোধনী। সেখানে বলা আছে, সাংবিধানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার অযোগ্য কেউ ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না। এক্ষেত্রে ট্রাম্প ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার সুযোগও থাকে না।
তার সবচেয়ে আইনসিদ্ধ উপায় হচ্ছে ২২ তম সংশোধনী বাতিল করা। তবে সেটা করতে হলে হাউজ এবং সিনেট উভয় অংশ থেকে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সমর্থন থাকতে হবে। আর অঙ্গরাজ্যগুলো থেকে তিন-চতুর্থাংশ (৫০টি অঙ্গরাজ্য থেকে ৩৮টি) সমর্থন থাকতে হবে। রিপাবলিকানদের এখন মাত্র ২৮টি অঙ্গরাজ্যে আসন আছে। সুতরাং, সংবিধান সংশোধন বাতিল করা তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব হলেও বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাববনা খুবই কম।
এছাড়াও ক্যাবিনেট থেকে তাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনীত করার বিষয়টিও এসেছে। ভবিষ্যতে তিনি হয়তো অনানুষ্ঠানিক ‘ছায়া প্রেসিডেন্ট’ হিসেবেও থাকতে পারেন। তবে এসব পরিস্থিতিতেও গুরুতর সাংবিধানিক ধারা লঙ্ঘন করেই আসতে হবে।

আইনগত দিক থেকে দেখলে ট্রাম্পের তৃতীয় মেয়াদের প্রেসিডেন্ট হওয়া অসম্ভবই বলা যায়। তাহলে কি তিনি ইচ্ছাকৃতভাবেই শোরগোল তুলছেন? সম্প্রতি সিগন্যাল কেলেংকারিতে ট্রাম্প প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের গোপন চ্যাট দ্য আটলান্টিকের সাংবাদিকের কাছে ফাঁস হয়ে যায়, যেখানে ইয়েমেনে হুতি যোদ্ধাদের ওপর আক্রমণের ব্যাপারে আলোচনা চলছিল। এতে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ট্রাম্প সেখান থেকে দৃষ্টি সরানোর জন্যই নতুনভাবে এই বিতর্ক তৈরি করেছেন।
তাছাড়া ট্রাম্প সবসময় লাইমলাইটে থাকতে পছন্দ করেন। সাধারণত দ্বিতীয় মেয়াদের সময় আমেরিকান প্রেসিডেন্টরা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যেতে থাকেন। কারণ তখন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট কে হবেন, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে যায়। ট্রাম্প হয়তো তার দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত এই বিতর্ক জিইয়ে রাখবেন, যেন তিনি আলোচনার বাইরে চলে না যান।
তবে আইনি বাধ্যবাধকতা কিংবা আলোচনায় থাকার বিষয় থাকলেও ট্রাম্পের তৃতীয় মেয়াদে আসার বিষয়টি একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছেন না তার সমালোচকরা।