আট শতক থেকে এগারো শতকের মধ্যবর্তী সময়। উত্তরের শীতল, রুক্ষ দেশ ছেড়ে দলে দলে স্ক্যান্ডিনেভিয়ানরা যাত্রা শুরু করেছিল অজানা পৃথিবীর দিকে। পায়ে সমুদ্রের নোনা জল, হাতের মুষ্টিতে ধরে রাখা কুঠারসমেত সেই যুদ্ধবাজ লোকদেরকেই আমরা আজ ‘ভাইকিং’ বা ‘নর্সম্যান’ নামে চিনি। প্রথমে তাদের নজর পড়েছিল ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডের উপকূলে। বিশেষ করে নিরীহ, নিরস্ত্র সন্ন্যাসীদের ছোট ছোট উপাসনালয় ছিল তাদের সহজ শিকার। তবে সময়ের সাথে সাথে তারা শুধু জলদস্যুতা বা লুণ্ঠন কার্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ব্যবসায়ী, অভিযাত্রী হিসেবেও তারা ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তরে।
ভাইকিং বলতে মূলত ডেনমার্ক, নরওয়ে এবং সুইডেনের বিভিন্ন গোত্রের মানুষকে বোঝানো হয়। তবে ফিনল্যান্ড, এস্তোনিয়া ও সামি জনগোষ্ঠীর মধ্যেও ভাইকিংদের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। তাদের মধ্যে জাতিগত ঐক্যের কোনো ছাপ ছিল না, ছিল না জাতীয় পতাকা বা দেশপ্রেমের বাঁধনে কোনো একাত্মতা। তাদের মাঝে একমাত্র মিল ছিল, তারা দূর উত্তরের এক অচেনা, অজানা ভূমি থেকে এসে একত্রিত হয়েছে। ইউরোপের চোখে তারা ছিল বর্বর এক গোষ্ঠী।
নিজেদের পরিচিত ভূমি ছেড়ে কেন এই ভাইকিংরা হঠাৎ বেরিয়ে পড়ল চারিদিকে? ইতিহাসবিদরা এখনো এই বিষয় নিয়ে দ্বিধান্বিত। তখনকার ইউরোপ ছিল ধনসম্পদে সমৃদ্ধ। নতুন নতুন বাণিজ্যকেন্দ্র, যেমন— দোরেস্টাড, কোয়েন্টোভিক, ইংল্যান্ডের হ্যামউইক, লন্ডন, ইয়র্ক হয়ে উঠছিল সমৃদ্ধির মুখ। ইউরোপের বাজারে স্ক্যান্ডিনেভিয়ানদের পশম তখন অত্যন্ত মূল্যবান হয়ে উঠেছিল। তারা ইউরোপীয়দের কাছ থেকে শিখেছিল উন্নত নৌ-প্রযুক্তি। তাদের পূর্বপুরুষরা ছিল বাল্টিক সাগরের জলদস্যু। এই সব অভিজ্ঞতা এবং সুযোগ কাজে লাগিয়ে ভাইকিংরা উত্তর সাগর পার করে বেরিয়ে পড়েছিল দূর অজানার খোঁজে।
৭৯৩ সালে, উত্তর ইংল্যান্ডের লিন্ডিসফার্ন নামের এক নিরীহ সন্ন্যাসী আশ্রমে নরওয়েজিয়ান ভাইকিংরা হানা দিলে ভাইকিং যুগের সূচনা ঘটে। এই হামলা ইউরোপের ধর্মীয় মননে প্রবল এক সঙ্কটের জন্ম দেয়। নব্য এই আগ্রাসীরা খ্রিষ্টান ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে বিন্দুমাত্র মর্যাদা দিত না। তাদের চোখে উপাসনালয় মানেই দুর্বল, নিরস্ত্র ধনসম্পদের ভাণ্ডার। দুই বছরের মধ্যে স্কাই, আয়োনা এবং রাথলিন দ্বীপের সন্ন্যাসী আশ্রমেও তারা আক্রমণ চালায়।
প্রথমদিকে ভাইকিংরা শুধুই উপকূলীয় অঞ্চল লুণ্ঠনে ব্যস্ত ছিল। তবে আট শতকের মধ্যভাগে, ফ্রান্সের সম্রাট লুইস দ্য পায়াসের প্রয়াণের পর, তার পুত্র লোথার নিজ ভাইদের বিরুদ্ধে ভাইকিংদের সাহায্য চায়। এই সুযোগে অন্যান্য ভাইকিংরাও বুঝে নেয়, ইউরোপীয় শাসকরা তাদের কাছ থেকে নিজ প্রজাদের রক্ষায় মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দিতে রাজি। এর পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
নবম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ড ভাইকিং আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যস্থল হিসেবে পরিণত হয়। শুধু লুটপাটই নয়, তারা এসব ভূখণ্ডে বসতিও স্থাপন করেছিল। স্কটল্যান্ডের উত্তর দ্বীপপুঞ্জ, শেটল্যান্ড ও অর্কনি, হিব্রিডস, এবং মূল ভূখণ্ডের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ভাইকিংদের অধিকারে চলে যায়। আয়ারল্যান্ডের বুকে ভাইকিংরা স্থাপন করে প্রথম বাণিজ্যিক শহর ডাবলিন, ওয়াটারফোর্ড, ওয়েক্সফোর্ড, উইকলো ও লিমেরিক। এসব বন্দর নগরীকে ঘাঁটি বানিয়ে তারা আয়ারল্যান্ডের অভ্যন্তরে এবং আইরিশ সাগর পেরিয়ে ইংল্যান্ডে ধারাবাহিক আক্রমণ চালায়।
৮৬২ সালে ফ্রাঙ্কিয়ার রাজা চার্লস দ্য বল্ড আরও কঠোর হয়ে পশ্চিম ফ্রাঙ্কিয়ায় প্রতিরক্ষা গড়ে তোলেন। যখন তিনি শহর, নদী, উপকূল এবং মঠসমূহে তিনি প্রাচীর তুলতে শুরু করেন, ঠিক তখনই ভাইকিংদের দৃষ্টি আবার ইংল্যান্ডের দিকে ঘুরে যায়।

৮৫১ সালের পর ইংল্যান্ডে যখন নতুন করে ভাইকিংদের আক্রমণের ঢেউ ওঠে, তখন সমগ্র রাজ্যের মধ্যে কেবল ওয়েসেক্স ছিল তাদের সামনে অবিচল। ডেনমার্কীয় ভাইকিংদের সেনাবাহিনী দখল করে নেয় পূর্ব অ্যাংলিয়া ও নর্থাম্বারল্যান্ড। ধ্বংস করে দেয় মারসিয়া। কিন্তু ৮৭১ সালে ওয়েসেক্সের রাজা আলফ্রেড দ্য গ্রেটের হাতে ডেনিশ বাহিনী পরাজিত হন। এরপর ডেনিশ বাহিনী ওয়েসেক্স ছেড়ে উত্তর দিকে চলে যায়। এই অঞ্চলই পরিচিত হয় ‘ডেনল’ নামে। এখানে ভাইকিংরা কৃষক ও বণিক রূপে জীবন গড়ে তোলে। ইয়র্ক শহর হয়ে ওঠে প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র। দশম শতাব্দীর প্রথম ভাগে আলফ্রেডের বংশধরেরা ইংল্যান্ডের ভাইকিং অঞ্চলগুলো পুনরুদ্ধার শুরু করে।
ইউরোপীয় মহাদেশে নবম শতাব্দীজুড়ে ভাইকিংদের তাণ্ডব অব্যাহত থাকে। ৮৪২ সালে তারা বিধ্বস্ত করে ফ্রান্সের উপকূলবর্তী শহর নঁত। পারি, লিমোজ, ওরলিয়ঁ, তুর এবং নিমের মতো শহর তাদের হামলার কবলে পড়ে। ৮৪৪ সালে তারা আরব-শাসিত সেভিল দখল করে নেয়। ৮৫৯ সালে পিসা শহর লুণ্ঠিত হয়, যদিও ফেরার পথে আরব নৌবাহিনী তাদের কঠোরভাবে প্রতিহত করে। ৯১১ সালে পশ্চিম ফ্রাঙ্কিয়ার রাজা এক সন্ধি অনুসারে ভাইকিং নেতা রোলোর হাতে তুলে দেন রৌঁ শহরসহ আশেপাশের অঞ্চল। এতে শর্ত ছিল, তিনি যেন সিন নদীপথে অন্য লুটেরা ভাইকিংদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেন। সেই অঞ্চলই আজকের নরম্যান্ডি। অর্থাৎ, ‘নর্থম্যানদের ভূমি‘।
নবম শতাব্দীতে নরওয়েজীয় ভাইকিংরা আইসল্যান্ডে উপনিবেশ স্থাপন শুরু করে। দশম শতাব্দীর শেষদিকে তাদের একাংশ এগিয়ে যায় গ্রিনল্যান্ডের দিকে। পরবর্তীকালের আইসল্যান্ডীয় সাগা থেকে জানা যায়, এরিক দ্য রেডের পুত্র লেইফ এরিকসন উত্তর আমেরিকায় সংঘটিত হওয়া অভিযানে নেতৃত্ব দেন। ‘ভিনল্যান্ড‘ নামে পরিচিত সেই ভূমিতে তারা তৈরি করে একটি সাময়িক বসতি। তবে এই অভিযানের পরে ভাইকিংদের আর স্থায়ী বসতির কোনো নিদর্শন পাওয়া যায়নি।

দশম শতাব্দীর মাঝামাঝি ডেনমার্কের নতুন খ্রিস্টান রাজা হ্যারাল্ড ব্লুটুথের শাসনামলে শুরু হয় ভাইকিংদের দ্বিতীয় যুগ। তখন থেকে এলোমেলো গোছের দস্যুতার বদলে রাজাদের নেতৃত্বে শুরু হয় পরিকল্পিত আক্রমণ। ইউরোপের উপকূল এবং ইংল্যান্ড আবার ভাইকিং আক্রমণের নিশানা হয়ে ওঠে। আলফ্রেডের বংশধরদের শাসন দুর্বল হয়ে পড়ায় হ্যারাল্ডের বিদ্রোহী পুত্র সেন ফর্কবিয়ার্ড ১০১৩ সালে সমগ্র ইংল্যান্ড জয় করে রাজা এথেলরেডকে নির্বাসনে পাঠান। সেনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ক্যানুট ডেনমার্ক, ইংল্যান্ড ও নরওয়ে মিলিয়ে একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।
কিন্তু ক্যানুটের দুই পুত্রের মৃত্যুর পর ১০৪২ সালে ইংল্যান্ডের সিংহাসন ফিরে যায় ইংল্যান্ডের পূর্বতন রাজপরিবারের হাতে। এডওয়ার্ড দ্য কনফেসর রাজা হিসেবে নির্বাচিত হন। নিঃসন্তান হওয়ায় তাঁর মৃত্যুর পর ইংল্যান্ডের সিংহাসনের দাবি জানান হ্যারল্ড গডউইনসন। হ্যারল্ডের সেনাবাহিনী স্ট্যামফোর্ড ব্রিজের যুদ্ধে নরওয়ের শেষ মহান ভাইকিং রাজা হ্যারাল্ড হারডরাডাকে পরাজিত করলেও, সে বছরের শেষদিকে নরম্যান্ডির ডিউক উইলিয়ামের কাছে হেরে যান। নরম্যান্ডির ভাইকিং বসতির বংশধর উইলিয়াম, ১০৬৬ সালের ক্রিসমাসে ইংল্যান্ডের রাজা হিসেবে অভিষিক্ত হবার পর ডেনিশ প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে দমন করেন।
১০৬৬ সালের এই ঘটনাগুলোই ছিল ভাইকিং যুগের অন্তিম অধ্যায়। তখন স্ক্যান্ডিনেভিয়ার সব রাজ্য খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হয় এবং ভাইকিংদের সংস্কৃতি ধীরে ধীরে খ্রিস্টীয় ইউরোপের মূলধারায় মিশে যেতে থাকে। ভাইকিংদের চিহ্ন আজও টিকে আছে স্থাননাম ও কিছু শব্দভাণ্ডারের মাধ্যমে। তবে আইসল্যান্ডেই ভাইকিংরা রেখে গেছে তাদের ঐতিহ্যের জীবন্ত স্মৃতি আইসল্যান্ডিক সাগার বিশাল সাহিত্যভাণ্ডার, যেখানে তাদের অতীতের বীরত্বগাথা সংরক্ষিত আছে।