ফিলিস্তিনের অধিবাসীদের অধিকার আদায়ে লড়াইরত হামাসের মুখপাত্র আবু ওবাইদার কথা মনে আছে? কিংবা আপনি কি আমেরিকা প্রখ্যাত মডেল বেল্লা হাদিদকে চেনেন?
৭ই অক্টোবরের হামলার পর আবু ওবাইদা বিশ্বজুড়েই এক পরিচিত ব্যক্তিত্ব। হামাসের সশস্ত্র শাখা আল কাসসাম ব্রিগেডের মুখপাত্র হিসেবে তিনি নিয়মিত সংবাদমাধ্যমের সামনে আসতেন। তার পুরো মুখ ঢাকা থাকত লাল ও সাদা রঙের কেফিয়্যাহ দিয়ে, যাতে তার চেহারা কোনোভাবে বোঝার উপায় না থাকে। অপরদিকে বেল্লা হাদিদ একজন প্রখ্যাত মডেল, যিনি টাইম ম্যাগাজিনের শীর্ষ একশো প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় স্থান পেয়েছিলেন। ‘সুপারমডেল’ পরিচয়ের পাশাপাশি তিনি ফিলিস্তিনের অধিকার আদায়ে এক নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তি হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছেন। ফিলিস্তিনের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে যে পদযাত্রাগুলো হয়, সেগুলোতে ঐতিহ্যবাহী সাদা-কালো কেফিয়্যাহ জড়িয়ে তার উপস্থিতি বেশ কয়েকবার দেখা গিয়েছে।
ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর চালানো গণহত্যার বিরুদ্ধে সরব হয়েছে পুরো বিশ্ব। পৃথিবীর হাজার হাজার শহরে বিভিন্নভাবে ইসরায়েলি গণহত্যার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে। সপ্তাহখানেক আগে ঢাকাতেও ‘মার্চ ফর গাজা’ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল সমাবেশ হলো ইসরায়েলের গণহত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে।
খেয়াল করলে দেখবেন- ঢাকার সেই সমাবেশে অসংখ্য মানুষ মাথায় সাদা-কালো কিংবা লাল-সাদা রঙের রুমাল জড়িয়ে জমায়েতে হাজির হয়েছে। শুধু ঢাকায়ই নয়, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এই ধরনের সমাবেশগুলোতে মানুষেরা ‘কেফিয়্যাহ ‘ বা সাদা-কালো/সাদা-লাল রুমাল গলায় পেঁচিয়ে বা মাথায় দিয়ে হাজির হয়। গণহত্যার শিকার ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে এই রুমাল পরিধান বর্তমানে এমন এক বিষয়, যা ছাড়া ফিলিস্তিনিদের সাথে সংহতি জানানো কোনো আয়োজনই পূর্ণতা পায় না।
একটু ইতিহাসের পাতায় চোখ বোলানো যাক। কেফিয়্যাহ কিন্তু শুরু থেকেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সাথে জড়িত ছিল না। আক্ষরিক অর্থে ‘ইরাকের কুফা নগরীতে উদ্ভাবিত পোষাক’ হলেও কুফার গন্ডি পেরিয়ে এটি এখন বিশ্বব্যাপী সমাদৃত পোষাক। ইতিহাসে কখনও এটি আভিজাত্য ও সম্মানের প্রতীক হিসেবে পরিগণিত হয়েছে, আবার কখনও এটি ছিল তীব্র রোদ ও ধুলাবালি থেকে বেঁচে থাকার ঢাল।
প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতায় ধর্মযাজকরা কেফিয়্যাহর মতো একটি কাপড় পরিধান করতেন। তখন ওটার মাধ্যমে বাকিদের থেকে আলাদা থাকতেন তারা, সমাজে তাদের বাড়তি মর্যাদা থাকত। তখন এমন এক সময় চলছিল, যখন কোনো অঞ্চলের অধিকাংশ জমির মালিকানা থাকত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে। সেই সময়ে একে বলা হতো ‘ইয়ামেঘ’ বা ‘শেমাঘ’। রাজনীতি ও অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণে এই ধর্মযাজকরা ছিল প্রভূত ক্ষমতাশালী।
এরপর সমাজের অভিজাতশ্রেণীর কাছ থেকে কেফিয়্যাহ চলে আসে আরবের কৃষকদের হাতে। তারা মরুময় অঞ্চলের প্রখর রোদ ও ধুলা থেকে বাঁচতে কেফিয়্যাহ মাথায় ও গলায় পেঁচিয়ে রাখতেন।

তবে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে কেফিয়্যাহর গল্পটা একেবারে অনন্য। বলা হয়ে থাকে, ফিলিস্তিন যখন ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের মাধ্যমে শাসিত হচ্ছিল, তখন ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্তি পেতে প্রায়ই ফিলিস্তিনিদের সাথে ব্রিটিশদের সংঘাত সৃষ্টি হতো। ফিলিস্তিনিরা গেরিলা কায়দায় ব্রিটিশদের উপর হামলা করে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেত। এমনই একটি গেরিলা আক্রমণে ব্রিটিশদের উপর হামলা করে ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা পালিয়ে যাওয়ার পর ব্রিটিশ প্রশাসন যখন এর কলাকুশলীদের ধরতে তদন্ত শুরু করে, তখন দেখা যায় আক্রমণকারীরা কেফিয়্যাহ পরিহিত ছিল।
ব্রিটিশরা এর সূত্র ধরে কেফিয়্যাহ পরিধানকারী ব্যক্তিদের সন্ধানে তল্লাশি চালায়। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়ায় ফিলিস্তিনিরা গণহারে কেফিয়্যাহ পরতে শুরু করে, যাতে ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা কোনোভাবে ধরাছোঁয়ার মধ্যে না থাকে। এরপর একপর্যায়ে ব্রিটিশরা কেফিয়্যাহর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে পোষাকটি আরও বেশি তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে। ফিলিস্তিনিরা প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে আরও বেশি করে কেফিয়্যাহ পরতে শুরু করেন।
তবে কেফিয়্যাহর পরিচিতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে যাওয়ার পেছনে ফিলিস্তিনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাতের অবদান সবচেয়ে বেশি। গত শতকের ষাটের দশকে ইয়াসির আরাফাতকে প্রকাশ্যে সবসময়ই মাথায় কেফিয়্যাহ পরিহিত অবস্থায় দেখা যেত। তার কেফিয়্যাহ পরিধানের নিজস্ব শৈলী ছিল৷ তিনি সবসময় ডান কাঁধে কেফিয়ার ঝুলন্ত অংশটি রাখতেন, যেটি দেখতে ১৯৪৮-পূর্ব স্বাধীন ফিলিস্তিনের মানচিত্রের মতো। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাতের মাথায় কেফিয়্যাহ পরার ব্যাপারটি এর আন্তর্জাতিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

১৯৭০ এর দশকের বিখ্যাত ফিলিস্তিনি যোদ্ধা লাইলা খালিদ সবসময় কেফিয়া পরিধান করতেন৷ তার ছবিগুলো রীতিমতো ‘আইকনিক’ হয়ে ওঠে। ঐক্যের প্রতীক হিসেবে ফিলিস্তিনি নারীরা ব্যাপকহারে কেফিয়্যাহ পরতে শুরু করেন।
১৯৮৭ সালে প্রথম ইন্তিফাদা ও ২০০০ সালে দ্বিতীয় ইন্তিফাদা হয়। দুটি ঘটনাতেই ফিলিস্তিনি তরুণেরা গণহারে কেফিয়্যাহ পরতে শুরু করে। তারা পুরো মুখ ঢাকার পরিবর্তে গলায় কেফিয়্যাহ পেঁচিয়ে পরতে শুরু করে। কারণ পুরো মুখ ঢেকে রাখলে জায়নবাদী সৈন্যদের সহজ লক্ষ্যে পরিণত হতেন তারা।
সাদা-কালো কেফিয়্যাহ হয়ে উঠেছে ফিলিস্তিনের অলিখিত পতাকা। ইসরায়েলি দখলদারিত্ব ও গণহত্যার প্রতিবাদে হাজারো মানুষের গলা, মুখ ও মাথায় কেফিয়্যাহ হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের প্রতীক। পোষাকটির সাথে জড়িয়ে গিয়েছে বছরের পর বছর ধরে চলা প্রতিরোধের ইতিহাস। শুধু পোষাকি গুরুত্ব ছাড়িয়ে এর শক্তি সঞ্চারণ কিংবা সংহতির প্রকাশের দিক এর তাৎপর্য বাড়িয়েছে বহুগুণে।
কেফিয়্যাহ ফিলিস্তিনিদের স্বপ্ন দেখায় একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের। সারা বিশ্বের মানুষ রক্তপাতহীন যে পৃথিবীর স্বপ্ন দেখে, কেফিয়্যাহ সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের তাড়না জোগায়। ফিলিস্তিনিদের মুক্তির সংগ্রামে কেফিয়্যাহ তাই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
তথ্যসূত্র
1) The History and Evolution of the Keffiyeh – Kuvrd
2) The origins of the Palestinian keffiyeh and how it came to symbolise resistance – The Daily Star
3) The history of keffiyeh: A traditional scarf from Palestine – Handmade Palestine
4) The Palestinian keffiyeh: All you need to know about its origins – Middle East Eye