Ridge Bangla

দুই জেনারেলের যুদ্ধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: সুদানের দারফুরে চলমান গণহত্যার নেপথ্যে

২০২৫ সালের ২৬ অক্টোবর র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) সুদানি সশস্ত্রবাহিনীর কাছ থেকে সুদানের উত্তর দারফুর প্রদেশের রাজধানী আল-ফাশির দখল করে নেয় এবং আরএসএফ সদস্যরা আল-ফাশিরে অন্তত ২,৫০০ বেসামরিক মানুষকে খুন করে। এই ঘটনাটি সুদানে চলমান গৃহযুদ্ধের অংশ। ২০২৩ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে সুদানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সুদানি সশস্ত্রবাহিনী এবং আরএসএফ-এর মধ্যে যুদ্ধ চলছে। এই যুদ্ধের ফলে এখন পর্যন্ত অন্তত দেড় লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছে, প্রায় ৪৩ লক্ষ মানুষ সুদান থেকে পালিয়ে গেছে এবং প্রায় ৯৬ লক্ষ মানুষ সুদানের অভ্যন্তরে উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, আরএসএফ কেন তাদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে নির্বিচারে বেসামরিক মানুষজনকে খুন করছে?

সুদানি গৃহযুদ্ধের ঐতিহাসিক ও সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট

উত্তর-পূর্ব আফ্রিকায় অবস্থিত সুদান আফ্রিকার তৃতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র। রাষ্ট্রটির আয়তন ১৮,৮৬,০৬৮ বর্গ কি.মি. এবং জনসংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটি। বর্তমান সুদানের ভূখণ্ডে অতি প্রাচীনকাল থেকে মানবসভ্যতা বিকশিত হয়েছিল। নীলনদের তীরে অবস্থিত সুদানের নুবিয়া অঞ্চলকে কেন্দ্র করে কেরমা এবং কুশ রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছিল এবং এই রাষ্ট্র দুইটির উভয়েই এক সহস্রাব্দের বেশি সময় ধরে টিকে ছিল। ৩৫০ সালে কুশের পতনের পর নুবিয়ানরা নুবাতিয়া, মুকুররা এবং আলওয়া নামক তিনটি খ্রিস্টান-অধ্যুষিত রাষ্ট্র সৃষ্টি করে। চতুর্দশ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যে আরব বেদুইনরা সুদানের সিংহভাগ ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে এবং সুদানের খ্রিস্টান-অধ্যুষিত রাষ্ট্রগুলোর পতন ঘটে। ষোড়শ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ পর্যন্ত সুদানের ভূখণ্ড প্রধানত তিনটি অংশে বিভক্ত ছিল: পূর্ব ও মধ্য সুদান ফুঞ্জ সালতানাতের নিয়ন্ত্রণে ছিল, পশ্চিম সুদানে দারফুর সালতানাতের আধিপত্য ছিল, আর উত্তর-পূর্ব সুদানের অংশবিশেষ ওসমানীয় রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে ছিল।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে ওসমানীয় রাষ্ট্রের করদ রাষ্ট্র মিসর সুদান দখল করে নেয়। ১৮৮২ সালে ব্রিটেন মিসর দখল করে নেয় এবং ১৮৯৯ সালে সুদানে ব্রিটেন ও ব্রিটিশ-নিয়ন্ত্রিত মিসরের যৌথ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশরা সুদানের মুসলিম-অধ্যুষিত উত্তরাংশ ও খ্রিস্টান-অধ্যুষিত দক্ষিণাংশকে পৃথকভাবে শাসন করে এবং এর মধ্য দিয়ে সুদানের বিভাজনের প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করে দিয়ে যায়। ১৯৫৬ সালে সুদান স্বাধীনতা লাভ করে, কিন্তু ১৯৫৫–১৯৭২ ও ১৯৮৩–২০০৫ সালে সুদানের দুই অংশের মধ্যে দুইটি রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং অবশেষে ২০১১ সালে দক্ষিণ সুদান সুদানের কাছ থেকে স্বাধীন হয়ে যায়। এদিকে সুদান স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে চারটি সামরিক-কর্তৃত্ববাদী সরকার (১৯৫৮–১৯৬৪; ১৯৬৯–১৯৮৫; ১৯৮৫–১৯৮৬ এবং ১৯৮৯–২০১৯) সুদানকে শাসন করেছে এবং দীর্ঘমেয়াদী সামরিক শাসন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, জাতিগত ও ধর্মীয় সংঘাত, অর্থনৈতিক স্থবিরতা ও ভূরাজনৈতিক সংঘর্ষের ফলে সুদান একটি পশ্চাৎপদ রাষ্ট্র হিসেবে থেকে গেছে।

২০০০-এর দশকে সুদানের দারফুর অঞ্চলে এবং দক্ষিণ কুরদুফান ও আন-নিল আল-আজরক প্রদেশদ্বয়ে স্বাধীনতাকামী/বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শুরু হয়। এসময় সুদানি রাষ্ট্রপতি উমর আল-বশির দারফুর অঞ্চলের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে এবং সুদানি সশস্ত্রবাহিনীর একটি প্রতিদ্বন্দ্বী নির্মাণের উদ্দেশ্যে আরব বেদুইনদের সমন্বয়ে গঠিত ‘জানজাবিদ’ মিলিশিয়াদেরকে ব্যবহার করতে শুরু করেন। এরা দারফুরে বসবাসরত আফ্রিকান মুসলিমদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালিয়ে কুখ্যাতি অর্জন করে। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে সুদানি সরকার জানজাবিদের মূল অংশকে ‘র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস’ (আরএসএফ) নামকরণ করে এবং এটি সুদানের একটি আনুষ্ঠানিক আধা-সামরিক বাহিনীতে পরিণত হয়। ২০১৮–২০১৯ সালে সুদানে তীব্র সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু হলে সুদানি সশস্ত্রবাহিনী ও আরএসএফ একটি অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত ও বন্দি করে। পরবর্তীতে ২০২১ সালে সুদানি সশস্ত্রবাহিনী ও আরএসএফ আরেকটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সুদানি প্রধানমন্ত্রী আব্দুল্লাহ হামদুককে ক্ষমতাচ্যুত করে সুদানের উপর পূর্ণ সামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।

দুই জেনারেলের দ্বন্দ্ব: পরিণামে গৃহযুদ্ধ

বশিরের পতনের পর সুদানকে শাসন করার জন্য যে ‘ট্রানজিশনাল সোভারিনটি কাউন্সিল’ প্রতিষ্ঠিত হয়, সেটির সভাপতি ছিলেন সুদানি সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল আব্দুল-ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং উপ-সভাপতি ছিলেন আরএসএফ-এর অধিনায়ক মুহাম্মাদ হামদান দাকলু মুসা (যাঁর ডাকনাম হামিদতি/হেমেতি)। বুরহান এবং হামিদতি রাজনৈতিক মিত্র ছিলেন, কিন্তু ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর তাঁদের মধ্যে সূক্ষ্ম প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। এসময় বুরহান পূর্ববর্তী রাষ্ট্রপতি বশিরের ইসলামপন্থী-কর্তৃত্ববাদী সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিত্বদের নতুন সরকারে অধিষ্ঠিত করতে শুরু করেন এবং হামিদতি এটিকে রাজধানী খার্তুম ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোর অভিজাতদের চিরাচরিত আধিপত্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হিসেবে বিবেচনা করেন। তদুপরি, হামিদতি যেহেতু সুদানের প্রান্তিক দারফুর অঞ্চল থেকে আগত, খার্তুমের রাজনৈতিক অভিজাতরা তাঁকে নিচু দৃষ্টিতে দেখতেন বলে ধারণা করা হয়। সর্বোপরি, আরএসএফকে সুদানি সশস্ত্রবাহিনীতে অঙ্গীভূত করে নেয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছিল, কিন্তু এই প্রক্রিয়াটি কেমন হবে এবং আরএসএফ-এর অফিসারদের সুদানি সশস্ত্রবাহিনীতে কোন ধরনের র‍্যাঙ্ক দেয়া হবে, এই বিষয়গুলো নিয়ে দুই বাহিনীর মধ্যে তিক্ততা সৃষ্টি হয়। অবশেষে ২০২৩ সালের ১৫ এপ্রিল আরএসএফ সমগ্র সুদান জুড়ে সুদানি সশস্ত্রবাহিনীর উপর আক্রমণ শুরু করে এবং এর মধ্য দিয়ে সুদানে আরেকটি গৃহযুদ্ধ আরম্ভ হয়।

এই যুদ্ধে বর্তমানে মিসর, সৌদি আরব, তুরস্ক, ইরান, রাশিয়া ও ইরিত্রিয়া সুদানি সশস্ত্রবাহিনীকে সমর্থন দিচ্ছে, আর ইমারাত, ব্রিটেন, চাদ, কেনিয়া, ইথিওপিয়া ও লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি আরএসএফকে সমর্থন দিচ্ছে। এই যুদ্ধের ফলে সুদান কার্যত খণ্ডবিখণ্ড হয়ে পড়েছে। আরএসএফ দারফুর অঞ্চলের সিংহভাগ ও কুরদুফান অঞ্চলের অংশবিশেষ দখল করেছে; আরএসএফ-এর মিত্র আব্দুল-আজিজ আল-হিলুর নেতৃত্বাধীন সুদান পিপলস লিবারেশন মুভমেন্ট – নর্থ (এসপিএলএম-এন [আল-হিলু]) দক্ষিণ কুরদুফান প্রদেশের অংশবিশেষ দখল করেছে; আব্দুল-ওয়াহিদ মুহাম্মাদ নূরের নেতৃত্বাধীন সুদান লিবারেশন মুভমেন্ট (এসএলএম-নূর) দারফুরের অংশবিশেষ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে, আর সুদানি সশস্ত্রবাহিনী ও তাদের মিত্ররা সুদানের বাকি অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে।

দারফুরে নতুন গণহত্যার নেপথ্যে

সুদানে চলমান যুদ্ধে উভয় পক্ষই বেসামরিক জনসাধারণের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত হয়েছে, কিন্তু আরএসএফ কর্তৃক সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের মাত্রা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি আরএসএফকে দারফুর অঞ্চলে গণহত্যা পরিচালনার দায়ে অভিযুক্ত করেছে। উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে দারফুর যুদ্ধ (২০০৩–২০২০) চলাকালেও জানজাবিদ ও জানজাবিদ থেকে উদ্ভূত আরএসএফের বিরুদ্ধে দারফুরে গণহত্যা পরিচালনার অভিযোগ উঠেছিল। আরএসএফ কর্তৃক দারফুরে বারবার গণহত্যা পরিচালনার পিছনে নানাবিধ কারণ রয়েছে।

প্রথমত, দারফুরে পরিচালিত গণহত্যার মূল কারণ হচ্ছে সুদানে বিদ্যমান আরব-আফ্রিকান দ্বন্দ্ব। ঐতিহাসিকভাবে, সুদানের অধিবাসীরা কৃষ্ণাঙ্গ এবং সুদানের নামটিই এসেছে আরবি ‘বিলাদ আস-সুদান’ শব্দগুচ্ছ থেকে, যার অর্থ ‘কৃষ্ণাঙ্গদের ভূমি’। চতুর্দশ শতাব্দীর পর থেকে আরব বেদুইনরা সুদানে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে এবং তাদের মাধ্যমে সুদানের স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে ইসলামের বিস্তার ঘটে। সুদানের স্থানীয় অধিবাসীদের একটি বড় অংশ আরব বেদুইনদের সঙ্গে সংমিশ্রণের ফলে এবং ইসলাম ধর্ম, আরবি ভাষা ও আরব সংস্কৃতি আত্মীকরণের মাধ্যমে ‘আরবীকৃত’ (Arabized) হয়ে যায়। বর্তমানে সুদানের জনসংখ্যার প্রায় ৭০% সুদানি আরব, যারা মূলত আরব ও আফ্রিকান মুসলিমদের মিশ্রণে সৃষ্ট একটি আরবীকৃত জাতিসত্তা। সুদানের জনসংখ্যার বাকি ৩০%-এর প্রায় ২৭% মুসলিম এবং ৩% খ্রিস্টান, কিন্তু এরা আরবীকৃত নয় এবং নিজেদের স্বতন্ত্র ভাষা, সংস্কৃতি ও রীতিনীতি বজায় রেখেছে। এই নৃগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে রয়েছে বেজা, নুবা, ফুর, নুবিয়ান, মাসালিত, জাগাওয়া প্রভৃতি।

সংখ্যাগরিষ্ঠ সুদানি আরবদের শরীরের বর্ণ সাধারণত বাদামি কিংবা বাদামি ও কালোর সংমিশ্রণ, অন্যদিকে সুদানি আফ্রিকানদের শরীরের বর্ণ সাধারণ পুরোপুরি কালো। এর ভিত্তিতে সুদানি আরবরা নিজেদেরকে সুদানি আফ্রিকানদের চেয়ে ভিন্ন বর্ণের (race) হিসেবে বিবেচনা করে। তদুপরি, সুদানি আরবরা সুদানি আফ্রিকানদেরকে নিজেদের চেয়ে পশ্চাৎপদ ও নিম্নস্তরের বলে মনে করে। সুদানের স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই রাষ্ট্রটির রাজনৈতিক ক্ষমতা সুদানের উত্তরাংশে কেন্দ্রীভূত সুদানি আরবদের কুক্ষিগত ছিল। এর ফলে সুদানে এক জটিল ধরনের বর্ণবাদের সৃষ্টি হয়েছে। উল্লেখ্য, সুদানি আরবরা নিজেদেরকে কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করে না, বরং সুদানি আফ্রিকানদেরকে কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে আখ্যায়িত করে। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বে আরব-আফ্রিকান নির্বিশেষে সকল সুদানি কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়।

সুদানে বিদ্যমান এই আরব–আফ্রিকান দ্বন্দ্ব সবচেয়ে তিক্তভাবে প্রকাশ পেয়েছে দারফুর অঞ্চলে। দারফুর অঞ্চলটি বর্তমানে পাঁচটি প্রদেশে বিভক্ত – উত্তর দারফুর, দক্ষিণ দারফুর, মধ্য দারফুর, পূর্ব দারফুর এবং পশ্চিম দারফুর। আরবিতে ‘দারফুর’ শব্দটির অর্থ ‘ফুরদের দেশ’। দারফুর অঞ্চলের অধিবাসীদের ৬০% থেকে ৬৫% বিভিন্ন আফ্রিকান নৃগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত এবং এদের মধ্যে সর্ববৃহৎ জনগোষ্ঠী হচ্ছে ফুর। এর পাশাপাশি দারফুরের আফ্রিকান নৃগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে জাগাওয়া ও মাসালিত উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে, দারফুর অঞ্চলের অধিবাসীদের ৩৫% থেকে ৪০% সুদানি আরব। এদের মধ্যে বাক্কারা আরবরা মূলত গরু চরায়, আর আব্বালা আরবরা মূলত উটপালক।

ফুর, জাগাওয়া, মাসালিত, বাক্কারা আরব, আব্বালা আরব – এরা সকলেই মুসলিম, কিন্তু বর্ণগত কারণে ফুর-জাগাওয়া-মাসালিতদের সঙ্গে সুদানি আরবদের তিক্ত সম্পর্ক বিদ্যমান। ফুর, জাগাওয়া ও মাসালিতদের অভিযোগ, সুদানি আরবরা তাদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বর্ণবৈষম্য করে আসছে এবং ২০০৩ সালে তারা স্বায়ত্তশাসন, রাজনৈতিক অধিকার ও বর্ণবিদ্বেষের অবসানের দাবিতে সুদানি সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। এই বিদ্রোহে সক্রিয় ছিল প্রধানত দুইটি সংগঠন – জাস্টিস অ্যান্ড ইকুয়ালিটি মুভমেন্ট (জেইএম) এবং সুদান লিবারেশন মুভমেন্ট (এসএলএম)। অন্যদিকে, দারফুরের আরবরা ১৯৮০-এর দশকেই নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য জানজাবিদ নামক মিলিশিয়া সৃষ্টি করেছিল, এবং দারফুরের বিদ্রোহ দমনের জন্য সুদানি সরকার জানজাবিদকে ব্যবহার করে। পরবর্তীতে জানজাবিদের মূল অংশকে আরএসএফ-এ রূপান্তরিত করা হয়, কিন্তু আরএসএফ আদর্শিকভাবে এখনো আরব আধিপত্যবাদী, বর্ণবাদী এবং আফ্রিকানবিদ্বেষী। অর্থাৎ, বর্ণবিদ্বেষ দারফুরে আরএসএফের যুদ্ধাপরাধের অন্যতম একটি অন্তর্নিহিত কারণ।

দ্বিতীয়ত, দারফুরের সুদানি আফ্রিকান ও সুদানি আরবদের মধ্যে ভূমি এবং পানির উপর অধিকার নিয়ে বিরোধ রয়েছে। দারফুরে বসবাসরত আফ্রিকানরা মূলত কৃষক, আর আরবরা মূলত অর্ধ-যাযাবর পশুপালক। ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়, যাযাবর পশুপালক সম্প্রদায় পশুপালনের জন্য নতুন নতুন জমির নিয়ন্ত্রণ নিতে গিয়ে কৃষকদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে, এবং এক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। তদুপরি, দারফুরের বেশ কিছু অংশে সুপেয় পানি বিরল এবং এজন্য পানির উৎসের নিয়ন্ত্রণ নিয়েও সেখানকার আফ্রিকান ও আরবদের মধ্যে তিক্ত বিরোধ রয়েছে। চলমান যুদ্ধে আরএসএফ দারফুরের ভূমি ও পানিসম্পদ সুদানি আরবদের নিয়ন্ত্রণে আনতে চাচ্ছে এবং এটিও দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘাতকে বাড়িয়ে তুলছে।

তৃতীয়ত, দারফুরে আরএসএফের অতীত কার্যক্রমের জন্য সেখানে বসবাসরত আফ্রিকানরা আরএসএফকে বিশ্বাস করে না এবং এজন্য ফুর, জাগাওয়া, মাসালিত প্রভৃতি নৃগোষ্ঠীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ চলমান যুদ্ধে সুদানি সশস্ত্রবাহিনীকে সমর্থন দিচ্ছে। দারফুরের আফ্রিকান নৃগোষ্ঠীগুলোর সশস্ত্র সংগঠন এসএলএম-এর বিভিন্ন উপদল এবং জেইএম সুদানি সশস্ত্রবাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করছে। এর ফলে আরএসএফ দারফুরের আফ্রিকানদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে তাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা পরিচালনা করছে।

সর্বোপরি, সুদানে চলমান গৃহযুদ্ধের শুরুতে আরএসএফের লক্ষ্য ছিল সুদানি সশস্ত্রবাহিনীর কাছ থেকে সমগ্র সুদানের নিয়ন্ত্রণ হস্তগত করা। কিন্তু খার্তুম প্রদেশে সুদানি সশস্ত্রবাহিনীর নিকট আরএসএফের পরাজয় আর দারফুর অঞ্চলে আরএসএফের নিকট সুদানি সশস্ত্রবাহিনীর পরাজয়ের ফলে দুই পক্ষের কোনো এক পক্ষের জন্য পুরো সুদানের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা খুবই কঠিন হয়ে উঠেছে। এমতাবস্থায় আরএসএফ ২০২৫ সালের এপ্রিলে দক্ষিণ দারফুর প্রদেশের রাজধানী নিয়ালাকে কেন্দ্র করে সুদানি সরকারের বিপরীতে আরেকটি সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে। অর্থাৎ, আরএসএফের শক্তিশালী ঘাঁটি হচ্ছে দারফুর, কিন্তু দারফুরের সংখ্যাগরিষ্ঠ আফ্রিকানরা আরএসএফকে সমর্থন করছে না। এমতাবস্থায় দারফুরে আরএসএফের রাজনৈতিক ও সামরিক অবস্থানকে শক্তিশালী করার জন্য এবং আরবদের অবস্থান শক্ত করার জন্য আরএসএফ দারফুরের আফ্রিকান নৃগোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে জাতিগত নিধনের পন্থা বেছে নিয়েছে।

উপসংহার

বস্তুনিষ্ঠভাবে চিন্তা করলে সুদানে চলমান গৃহযুদ্ধ মূলত আদর্শিক, নৃতাত্ত্বিক, ধর্মীয়, বা বর্ণগত কোনো যুদ্ধ নয়। সুদানি সশস্ত্রবাহিনী কিংবা আরএসএফ কোনোটিরই কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শ নেই। যুদ্ধটি হচ্ছে মূলত সুদানি আরবদের দুই অংশের মধ্যে, যেখানে সুদানি আরব-নিয়ন্ত্রিত সুদানি সশস্ত্রবাহিনী দারফুরকেন্দ্রিক আফ্রিকান মুসলিম সশস্ত্র গ্রুপগুলোর সঙ্গে জোট বেঁধেছে আর সুদানি আরব-নিয়ন্ত্রিত আরএসএফের মিত্রে পরিণত হয়েছে কুরদুফানকেন্দ্রিক আফ্রিকান খ্রিস্টান ও সর্বপ্রাণবাদীদের সশস্ত্র গ্রুপ এসপিএলএম-এন (আল-হিলু)। এই যুদ্ধ মূলত দুই জেনারেলের মধ্যেকার ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, এবং এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে বর্ণবিদ্বেষজনিত, অর্থনৈতিক, সামরিক ও রাজনৈতিক হিসেব-নিকেশের পরিণতিতে দারফুরের অধিবাসী আফ্রিকান মুসলিমরা গণহত্যার শিকার হচ্ছে।

এই পোস্টটি পাঠ হয়েছে: ৩০

আরো পড়ুন