Ridge Bangla

ব্রাজিলের জার্সিতে যারা খেললে বদলে যেতে পারত দেশটির ফুটবল-ভাগ্য!

ফুটবল কখনো কখনো খুব সূক্ষ্ম ব্যবধানের খেলা। একটা ভুল খেলোয়াড় বদলি করা, নেওয়া বা বাদ দেয়ার ফল হতে পারে ভাবনার অতীত। আর তা যদি হয় বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে, তা-ও আবার ব্রাজিলের মতো দলের জন্য- আক্ষেপ তো হওয়াই স্বাভাবিক। ২০১০-২০২২ বিশ্বকাপের ব্রাজিল দলগুলোয় অন্তত একটি পজিশনে যোগ্য খেলোয়াড়ের অভাব ছিল যেটি তাদের বাদ পড়ার অন্যতম কারণ হয়তে দাঁড়ায়। আফসোসের ব্যাপার হলো- তাদের এমন তারকা ভূমিপুত্র ছিলো যারা ব্রাজিলের হয়ে খেললে হয়তো ইতিহাসটা অন্যরকম হতো। চলুন দেখে নেয়া যাক এমনই কয়েকজন খেলোয়াড়ের নাম।

থিয়াগো মোত্তা

ইন্টারের হয়ে ট্রেবলজয়ী সাবেক এই বার্সা খেলোয়াড়ের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ব্রাজিলে। পাঠক কি স্মরণ করতে পারেন ২০১০ বিশ্বকাপে বাদ পড়ার সেই ম্যাচে কে লাল কার্ড পেয়েছিলেন? ফিলিপে মেলো, ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার। আরেকটু বলে রাখি- সেই বছর ইন্টারের হয়ে ট্রেবল জেতেন মোত্তা, ইউরোপের অন্যতম সেরা একজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে। অথচ মোত্তাকে প্রথম দলে ডাকেন আলবার্তো পেরেইরা ২০০৩ সালে। দুটো প্রীতি ম্যাচও খেলেন।

থিয়াগো মোত্তা

তখন জুনিনহো, গিলবার্তো সিলভাদের জন্য দলে জায়গা হয়নি। কিন্তু ২০১০ সালে দল ঘোষণার সময় দুঙ্গার হাতে থিয়াগো মোত্তার মতো আর কোনো অস্ত্র ছিল না। ব্রাজিলের হাতে কোনো ডিপ লায়িং প্লেমেকার নেই, নেই প্রথাগত ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার। মোত্তা ছিল একদম সেরা কম্বিনেশন। দুঙ্গা বেছে নিলেন ফিলিপে মেলোকে। মেলোর ভুলেই ব্রাজিল পড়লো বাদ। আর মোত্তা ২০১১ সালে ইতালির হয়ে খেলা শুরু করেন।

বলে রাখা ভাল, থিয়াগো মোত্তা ইতালিয়ান ক্লাব বোলোনিয়ার হয়ে কোচ হিসেবে ইউরোপকে প্রথম তাক লাগিয়ে দেন, যদিও জুভেন্তাসের কোচ হিসেবে সময়টা ভাল যায়নি। এখনও তাকে ইউরোপের সম্ভাবনাময় কোচদেরই একজন হিসেবে দেখা হয়। হালের এই কোচের সংকটের দিনে ব্রাজিল কি তাহলে একজন কোচও হারালো?

ডিয়েগো কস্তা

অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ ও চেলসির হয়ে খেলা এই যুদ্ধংদেহী স্ট্রাইকারকে কে না চেনেন? প্রথাগত স্ট্রাইকার ও দলের জন্য জীবন দিতে চাওয়ার মানসিকতার জন্য তার ব্যাপক পরিচিতি। এই ডিয়েগো কস্তার সামনেও সুযোগ ছিল ব্রাজিলের হয়ে খেলার। ব্রাজিলের হয়ে দুটো প্রীতি ম্যাচও খেলেছিলেন।

ডিয়েগো কস্তা

২০১৪ সালের বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশ ব্রাজিল হওয়ায় ব্রাজিলের কোনো বাছাইপর্বের ম্যাচ খেলার প্রয়োজন হয়নি। অফিসিয়াল ম্যাচ খেললে হয়তো আর জাতীয় দল সুইচ করতে পারতেন না কস্তা। কিন্তু খেলেছিলেন প্রীতি ম্যাচ। ২০১৩ সালে ব্রাজিলের কনফেডারেশন কাপ জয়ের সময় ফেড স্ট্রাইকার হিসেবে এত ভাল খেলেন যে কোচ লুইস ফেলিপে স্কোলারি ডিয়েগো কস্তাকে বিবেচনায়ই নেননি। আর এই ফ্রেড ২০১৪ সালের ঘরের মাঠে একটি গোলও করতে পারেনি গোটা বিশ্বকাপে। অন্যদিকে ২০১৩-১৪ মৌসুমে ডিয়েগো কস্তা অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদকে কয়েক দশকের প্রথম লীগ ট্রফি এনে দেন, নিয়ে যান চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ফাইনালে। সেই মৌসুমের বিশ্বের সেরা ৩ স্ট্রাইকারের একজন কস্তা স্পেনের হয়ে নিজের জন্মভূমি ব্রাজিলে বিশ্বকাপ খেলতে যান। কিন্তু স্পেনের টিকিটাকার সাথে কস্তার স্টাইল কখনও খাপ খায়নি। ফলাফল কস্তাও বিশ্বকাপে ব্যর্থ।

কিন্তু বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, ব্রাজিলের লং বল কৌশলের সাথে ডিয়েগো কস্তার মতো স্ট্রাইকার ছিল প্রয়োজনীয়। স্কোলারি হয়তো আরেক স্ট্রাইকার জো-র বদলে নিতেও পারতেন। এই ভুল সিদ্ধান্তের ফলাফল ইতিহাসের সেরা লজ্জার ১-৭ এ পরাজয় দিয়ে শেষ হয়।

থিয়াগো আলকান্তারা

এর চেয়ে বড় ভুল মনে হয় অথচ ব্রাজিলিয়ান ফুটবল ফেডারেশন (সিবিএফ) গত এক দশকে করেনি। থিয়াগো আলকান্তারা ছিল সেস্ক, জাভি, ইনিয়েস্তার পর লা মাসিয়ার সবচেয়ে সেরা মিডফিল্ড প্রতিভা। এরপর এক দশক বার্সা, বায়ার্নের হয়ে মাঝমাঠে আলো ছড়িয়েছেন। একজন মিডফিল্ডারের মাঝে যা যা থাকা দরকার তার সবই ছিল। আর ২০১০ এর পর থেকে ব্রাজিলে থিয়াগো আলকান্তারার কাছাকাছি প্রোফাইলের কোনো খেলোয়াড় উঠে আসেনি। একজন মাঝমাঠের নিয়ন্ত্রকের অভাবে ব্রাজিল ক্রমাগত তার খেলা লং বল কৌশলের দিকে বদলাতে থাকে।

থিয়াগো আলকান্তারার বাবা মাজিনহো ছিলেন ১৯৯৪ সালে ব্রাজিলের হয়ে বিশ্বকাপজয়ী খেলোয়াড়। থিয়াগোর স্পষ্ট ইচ্ছা ছিল ব্রাজিলের হয়ে খেলা। অথচ ব্রাজিলিয়ান ফুটবল ফেডারেশন (সিবিএফ)
সিদ্ধান্ত নিলো যেসব খেলোয়াড় ব্রাজিলের বাইরে বড় হয়েছেন তারা ব্রাজিলের হয়ে ডাক পাবেন না।

থিয়াগো আলকান্তারা
থিয়াগো আলকান্তারা

এদিকে থিয়াগো বড় হয়েছিলেন স্পেনে বার্সেলোনার একাডেমিতে। ২০১০ সালের পর থেকে স্পেনের হয়ে খেলা মানেই ছিল নিশ্চিত সাফল্য। অন্যদিকে ব্রাজিল ধুকছিল। কিন্তু তবুও থিয়াগো আলকান্তারা চেয়েছিলেন কেবল ব্রাজিল। ব্রাজিল তাকে ডাকেনি। ফলাফল- থিয়াগো স্পেনের হয়ে খেলার সিদ্ধান্ত নেন।

২০১৮ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের হয়ে সেই জায়গায় খেলেন পাউলিনহো, ফার্নান্দিনহো। ফুটবনলপ্রেমীদের মাঝে যারা অল্প হলেও খোজ রাখেন তারা জেনে থাকবেন অবশ্যই যে থিয়াগো আলকান্তারার বদলে তাদের কেউই মাঝমাঠ নিয়ন্ত্রণে কোনোভাবেই সমদক্ষ না। ২০১৮ সালে আবার সেই পাউলিনহো, রেনাতো আগুস্তো।

২০২২ বিশ্বকাপে যে ক্রোয়েশিয়া ম্যাচে ব্রাজিল হারে, সেই ম্যাচে ক্যাসেমিরো বাদে কোনো প্রথাগত সেন্টার মিডফিল্ডার ছিলই না। সেই থিয়াগো আলকান্তারাকে হারানোর পর থেকে ব্রাজিল আর কখনো এমন কোনো খেলোয়াড় তুলে আনতে পারেনি যার মাধ্যমে ইউরোপীয় মাঝমাঠ নিয়ন্ত্রণের কোনো জবাব দেয়া যায়। সম্ভবত এর চেয়ে বড় ক্ষতি সাম্প্রতিক ব্রাজিলের ইতিহাসে আর হয়নি।

এই তালিকা আরো লম্বা করা যায়- ডেকো, পেপে, জর্জিনহো, মার্কোস সেনাসহ অনেকে।

প্রতিষ্ঠিত প্রায় সব পরিসংখ্যান সাইটের তথ্যানুযায়ী ব্রাজিলই ইউরোপে সবচেয়ে বেশি প্রতিভা বা খেলোয়াড় পাঠায় গত দশকে। অথচ খেলার সুযোগ পায় মাত্র ২৩ জন। মনে হতেই পারে- এ আর এমন কী ক্ষতি! কিন্তু তবুও এমন কিছু প্রতিভাবান খেলোয়াড় ব্রাজিলের নাগরিক হয়েও অন্যদের হয়ে খেলেছেন যারা ব্রাজিলে ঠিক ঐ সময়টায় সমস্যার সবচেয়ে সুন্দর সমাধান হতো। উপরের তিনজন এমনই এক আক্ষেপ। হয়তো গত চার বিশ্বকাপে ব্রাজিলের আশাভঙ্গের ইতিহাস অন্যরকমও হতে পারতো বিশ্বকাপে এই তিন তারকা গায়ে হলুদ-সবুজের জার্সি উঠলে!

আরো পড়ুন