রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের (আরএনপিপি) বিদ্যুৎ বিক্রির জন্য বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (পিপিএ) নিয়ে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (এনপিসিবিএল) এবং বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন (বিএইসি)-এর মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। দুই পক্ষই আইনি কাঠামো ও নীতিগত অবস্থান থেকে নিজেদের যুক্তি তুলে ধরছে।
এনপিসিবিএলের মতে, ২০১৫ সালের ‘পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আইন’ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি রূপপুর প্রকল্পের একমাত্র ‘অপারেটিং অর্গানাইজেশন’। আইনটির ৪(২) ধারা অনুসারে, কেন্দ্রের পরিচালনা, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমের সম্পূর্ণ দায়িত্ব এনপিসিবিএলের ওপর ন্যস্ত। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা যুক্তি দিচ্ছেন, পিপিএ একটি বাণিজ্যিক চুক্তি, যেখানে শুধুমাত্র অপারেটর সংস্থারই স্বাক্ষর করার আইনি অধিকার রয়েছে। পাশাপাশি ৭(২) ধারায় বলা হয়েছে, এনপিসিবিএলকে আন্তর্জাতিক মান ও নিরাপত্তা নির্দেশিকা অনুসারে কেন্দ্র পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার পূর্ণ দায়িত্ব পালনে প্রস্তুত থাকতে হবে।
এনপিসিবিএলের বক্তব্য অনুযায়ী, আইনের কাঠামো অনুযায়ী বিএইসি ‘ওনার অর্গানাইজেশন’ বা মালিকানাধীন সংস্থা হিসেবে রূপপুর প্রকল্পের তত্ত্বাবধানে রয়েছে, তবে তারা সরাসরি অপারেশনে বা বিদ্যুৎ বিক্রির বাণিজ্যিক প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে না। বিদ্যুৎ সেক্টরে প্রচলিত ‘একক ক্রেতা’ মডেল অনুসারে, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) কেবলমাত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে দীর্ঘমেয়াদি পিপিএ স্বাক্ষর করে। তাই, এনপিসিবিএল মনে করে, বিদ্যমান আইন ও নীতিমালার আলোকে কেবল তাদের সঙ্গেই পিডিবি-র চুক্তি স্বাক্ষর করা উচিত।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি বিজ্ঞানী সংঘ (বায়েসা) এর প্রেসিডেন্ট জনাব এএসএম সাইফুল্লাহ গত ২২ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “পরমাণু শক্তি কমিশন (বিএইসি) আইনি মালিক হয়েও এখন বিদ্যুৎ বিভাগ তাদের পাশ কাটিয়ে সরাসরি নবগঠিত নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (এনপিসিবিএল)-এর সঙ্গে পিডিবির বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (পিপিএ) করতে উদ্যোগী হয়েছে। এতে স্পষ্টভাবে বিএইসির কর্তৃত্ব খর্ব করার চেষ্টা চলছে।”
বায়েসার সাধারণ সম্পাদক ড. মোঃ গোলাম রসুল স্বাক্ষরিত এক লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়, রূপপুর প্রকল্পের জন্য ২০১১ সালে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে স্বাক্ষরিত আন্তঃরাষ্ট্রীয় চুক্তিতে বিএইসিকে ‘কাস্টমার’ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে কেন্দ্র নির্মাণ, জ্বালানি সরবরাহ এবং প্রয়োজনীয় লাইসেন্স গ্রহণের সকল কার্যক্রমই বিএইসি সম্পন্ন করে।
২০১৭ সালের ‘বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন আইন’-এর ধারা ১০(৪) অনুযায়ী, কমিশনকে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, প্রকল্প বাস্তবায়ন, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বাণিজ্যিকীকরণের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। ফলে, বায়েসার মতে, রূপপুর প্রকল্পের মালিক সংস্থা হিসেবে পিপিএ চুক্তিতে বিএইসির অংশগ্রহণ আবশ্যক। অন্যদিকে, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আইন, ২০১৫-এর কার্যাবলিতে (ধারা-৭) কোম্পানীকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বাণিজ্যিকীকরণ সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনার কোন ক্ষমতা প্রদান করা হয়নি।
তাদের ব্যাখ্যায় আরও বলা হয়, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন আইন, ২০১৭-এর ধারা-৩ (আইনের প্রাধান্য) মোতাবেক ‘অন্য কোন আইন বা উহার অধীন প্রণীত বিধিতে এই আইনের অসামাঞ্জস্যপূর্ণ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের বিধানাবলি প্রাধান্য পাইবে’। যেহেতু পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আইনটি ২০১৫ সালে এবং বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন আইন ২০১৭ সালে প্রণীত হয়েছে, সেহেতু ২০১৭ সালের পূর্বে প্রণীত অন্য কোনো আইন বা সেটার অধীনে প্রণীত বিধিতে যা কিছুই থাকুক না কেন, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন আইন, ২০১৭-এর বিধানাবলি প্রযোজ্য হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিষয়টি স্পর্শকাতর এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের আস্থা বজায় রাখতে আইন মেনে এবং স্বচ্ছতার সাথে সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। রূপপুর প্রকল্পের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন বাংলাদেশের বিদ্যুৎ নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় উভয় পক্ষের যুক্তি বিচার-বিশ্লেষণ করে, আইনি কাঠামো, আন্তর্জাতিক রীতিনীতি এবং জাতীয় স্বার্থের সমন্বয় করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।