Ridge Bangla

রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে নিয়মবহির্ভূত বরখাস্ত, প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের পাহাড়সম অভিযোগ

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে চলমান অস্থিরতা এবং কর্মকর্তাদের বরখাস্ত নিয়ে দেশব্যাপী উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি প্রকল্প পরিচালক (পিডি) ও নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (এনপিসিবিএল) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ড. মো. জাহেদুল হাছানের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা এবং প্রকৌশলীদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণের অভিযোগকে কেন্দ্র করে প্রকল্পে বড় ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে।

গত ২৮ এপ্রিল থেকে ৬ মে পর্যন্ত প্রকল্পের প্রকৌশলী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পেশাগত দাবি-দাওয়ার পাশাপাশি ড. জাহেদুলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে আন্দোলনে অংশ নেন। তাদের দাবি ছিল- কর্মপরিবেশের উন্নয়ন, সুষ্ঠু পদোন্নতি, দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা এবং মেধাভিত্তিক মূল্যায়ন। তবে এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের জবাবে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ কঠোর অবস্থান নেয়।

এরই অংশ হিসেবে প্রথমে ১৮ জন প্রকৌশলীকে চাকরিচ্যুত করা হয়, এবং পরবর্তীতে আরও ৮ জনকে সাময়িক বরখাস্ত করে প্রকল্প থেকে বহিষ্কার করা হয়। বরখাস্তের চিঠিতে কোনো সুস্পষ্ট কারণ উল্লেখ না থাকায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাতে দেখা গেছে চাকরিচ্যুত প্রকৌশলীদের।এনপিসিবিএলের পক্ষ থেকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, বরখাস্ত হওয়া কর্মকর্তারা কোম্পানির আইনবিরোধী কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন। তবে প্রকৌশলীরা দাবি করেছেন, আন্দোলনে অংশগ্রহণের কারণেই তাদের টার্গেট করে বরখাস্ত করা হয়েছে।

প্রকল্পের সাইট অফিস ইনচার্জ রুহুল কুদ্দুস সংবাদ মাধ্যমকে জানান, বরখাস্তের নোটিশ যথাযথভাবে ইমেইলের মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে এবং তা প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহে জানানো হয়েছে। চাকরিচ্যুতদের একজন, উপ-তত্ত্বাবধায়ক হাশমত আলী বলেন, তিনি কোনো ধরনের অনিয়মে জড়িত ছিলেন না। বরং চাকরিচ্যুতির কারণ হিসাবে কী দেখানো হয়েছে তা নিয়েই তিনি অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। তিনি বলেন, “আমি গ্রিন সিটি আবাসিক এলাকা ছাড়ার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, তাই বিস্তারিত বলা সম্ভব হচ্ছে না। তবে আইনি পরামর্শ নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করব।”

চাকরি হারানো প্রকৌশলীদের মধ্যে ১৫ জন বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার এবং ৩ জন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার। তাদের মতে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে যোগ্য ও কর্মদক্ষ প্রকৌশলীদের টার্গেট করে চাকরিচ্যুতি ঘটানো হয়েছে, যাতে প্রকল্পে ঠিকাদারদের স্বার্থ রক্ষা করা যায়। এভাবে অভিজ্ঞ প্রকৌশলীদের সরিয়ে দিয়ে প্রকল্পের কাজ বুঝে নেওয়ার সক্ষমতা হ্রাস করা হচ্ছে, যা দেশের পারমাণবিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি।

এদিকে বরখাস্তের আদেশে ‘কারণ দর্শানো’র নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রকৌশলীরা অভিযোগ করেছেন, প্রকৃত কারণ গোপন রেখে শুধুমাত্র ‘বিশৃঙ্খলার দায়ে’ ছাঁটাই করা হয়েছে, যা প্রকল্পের বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। প্রকল্পের ভেতর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে কোনো রকম বিশৃঙ্খলা সম্ভব নয় বলে দাবি করেন তারা। তাদের মতে, প্রকল্প পরিচালক ড. জাহেদুল হাসান  ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ফাঁক-ফোকর কাজে লাগিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ দুর্নীতির সুযোগ নিয়েছেন। তিনি প্রকল্পের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ পদে নিজেকে রাখায় কোনোরকম জবাবদিহিতা নেই।

ড. জাহেদুল হাছান

ড. জাহেদুল একাধারে প্রকল্প পরিচালক, এমডি, ফাইনান্স প্রধান, মানবসম্পদ প্রধান, স্টেশন ডিরেক্টর, প্রশাসনিক প্রধান এবং সিকিউরিটি অফিসার। এর ফলে প্রকল্পে গণতান্ত্রিক ও পেশাদার ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়েছে। অভিযোগ রয়েছে, তিনি পছন্দের ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দিতে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অনিয়ম করেন এবং তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে তদন্ত চলছে। তার এই আচরণ প্রকল্পের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। তিনি মেধাবী কর্মকর্তাদের ছাঁটাই করে ঠিকাদারপন্থী পরিবেশ তৈরি করছেন, যাতে প্রকল্প হস্তান্তরের সময় ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে প্রশ্ন না ওঠে।

এছাড়াও, কর্মীদের আশ্বাস দিয়ে প্রতারণা এবং প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করার প্রবণতা, প্রকল্পে সেবা নীতিমালা জারির নামে বরখাস্তের দিনই উদ্দেশ্যমূলকভাবে আইন সংযোজন করে চাপিয়ে দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে। প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রিতা, ভেন্টিলেশন সিস্টেম, গ্রিড সংযোগে ব্যর্থতা ঢেকে রাখার চেষ্টাও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ড. জাহেদুলের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২৯ মে ২০২৫। তবে ঠিকাদাররা তার মেয়াদ চুক্তিভিত্তিকভাবে বাড়ানোর জন্য চাপ দিচ্ছে বলে জানা গেছে। এতে দেশীয় স্বার্থ উপেক্ষিত হয়ে প্রকল্পে বিদেশি কর্তৃত্ব আরো শক্তিশালী হবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

চাকরিচ্যুত প্রকৌশলীরা মনে করেন, ড. জাহেদুল হাছানকে পুনরায় নিয়োগ দিলে প্রকল্পের ভবিষ্যৎ ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়বে। কারণ, তিনি যোগ্য উত্তরসূরি গড়ে তোলার পরিবর্তে সব পদ নিজে ধরে রেখেছেন, এবং প্রকল্প পরিচালনায় অপারগতার পরিচয় দিয়েছেন। ১০ বছরেও তিনি কাউকে প্রশিক্ষিত ও সক্ষম করে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন।

এমতাবস্থায়, দেশের স্বার্থে এবং প্রকল্পের নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ড. জাহেদুল হাছানকে দায়িত্ব থেকে অবিলম্বে অপসারণ করার দাবি জানিয়েছেন বরখাস্তকৃত প্রকৌশলীসহ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাঁরা প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, রূপপুরের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে সঠিক নেতৃত্ব ও সিদ্ধান্তের ওপর, যা ড. জাহেদের হাতে নিরাপদ নয়।

আরো পড়ুন