আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাষ্ট্রগুলোর ভৌগোলিক অবস্থান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এটা একদিকে যেমন রাষ্ট্রের শক্তির মূল উৎস হয়ে উঠতে পারে, অন্যদিকে আবার একটি রাষ্ট্রের চিরন্তন দুর্বলতার কারণ হয়েও দাঁড়াতে পারে। ভারতের অন্তর্ভুক্ত শিলিগুড়ি করিডোর একইসঙ্গে ভারতের শক্তিমত্তা ও দুর্বলতার সেই উৎস।
শিলিগুড়ি করিডোর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশে অবস্থিত একটি ক্ষুদ্র ভূখণ্ড। পশ্চিমবঙ্গের তৃতীয় বৃহত্তম শহর শিলিগুড়ি ও এর আশেপাশের অঞ্চলের সমন্বয়ে এই করিডোরটি গঠিত। এর দৈর্ঘ্য ৬০ কি.মি. এবং প্রস্থ ২২ কি.মি., কিন্তু কোনো কোনো স্থানে করিডোরটির প্রস্থ আরো কম (১৭ কি.মি.-এর কাছাকাছি)।
ভারত কার্যত দুটি ভূখণ্ডে বিভক্ত: ভারতীয় মূল ভূখণ্ড, এবং উত্তর-পূর্ব ভারত। যদি শিলিগুড়ি করিডোর না থাকতো, সেক্ষেত্রে ভারতীয় মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব ভারতের কোনো স্থল সংযোগ থাকত না। বলে রাখা ভালো, উত্তর-পূর্ব ভারত সম্পূর্ণভাবে স্থলবেষ্টিত, ফলে সমুদ্রপথে ভারতীয় মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব ভারতের যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব নয়।
প্রশাসনিকভাবে, উত্তর-পূর্ব ভারত ‘উত্তর-পূর্ব অঞ্চল’ (North Eastern Region, ‘NER’) নামে পরিচিত, এবং ভারতের ২৮টি প্রদেশের মধ্যে ৮টি এই অঞ্চলে অবস্থিত। সেই প্রদেশগুলো হচ্ছে সিকিম, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, মিজোরাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড এবং অরুণাচল প্রদেশ। এগুলোর মধ্যে সিকিম বাদে অবশিষ্ট ৭টি প্রদেশ একত্রে সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত।
রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক ও অন্যান্য কারণে সেভেন সিস্টার্সে বিচ্ছিন্নতাবাদ/স্বাধীনতা আন্দোলন ও নানা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, বিশেষত জাতিগত ও ধর্মীয় সংঘাত বিরাজমান। এর ফলে অঞ্চলটির ওপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা ভারতের জন্য এমনিতেই বেশ কঠিন। এর উপর, চীন অরুণাচল প্রদেশের বৃহদাংশকে নিজেদের ভূখণ্ড হিসেবে দাবি করে।
এই পরিস্থিতিতে ভারতের ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষা ও উত্তর-পূর্ব ভারতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য নয়াদিল্লিকে এই অঞ্চলে শক্তিশালী সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখতে হয়। ‘লুক ইস্ট’ ও ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্কের বিস্তার ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। এক্ষেত্রে সেভেন সিস্টার্স ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যবর্তী সংযোগ সেতু।
কিন্তু ভারতীয় মূল ভূখণ্ড ও উত্তর-পূর্ব ভারতের মধ্যে একটিমাত্র সংযোগপথ রয়েছে, আর সেটি হচ্ছে শিলিগুড়ি করিডোর। মানচিত্রে এই করিডোরের আকৃতি অনেকটা মুরগির ঘাড়ের মতো। এজন্য এই করিডোরকে ভারতের মুরগির ঘাড় বা India’s Chicken’s Neck হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
অবশ্য আকৃতিগত দিকের পাশাপাশি ভূকৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকেও এটি কার্যত একটি ‘চিকেন’স নেক’, কারণ এই ভারতের কোনো শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র চাইলেই এই মুরগির ঘাড় মটকে দিতে পারে। শিলিগুড়ি করিডোর দখল করে ভারতীয় মূল ভূখণ্ড থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারে।
ভারতের জন্য শিলিগুড়ি করিডোর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই সংকীর্ণ করিডোরের মাধ্যমে ভারতীয় মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব ভারতের সংযোগ রক্ষা হয়েছে, এবং এর ফলে নয়াদিল্লির পক্ষে উত্তর-পূর্ব ভারতের ওপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। যদি শিলিগুড়ি করিডোর না থাকতো, সেক্ষেত্রে নয়াদিল্লির পক্ষে উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রদেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়া বিচ্ছিন্নতাবাদী/স্বাধীনতাকামী আন্দোলনগুলোকে দমন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়তো। কারণ সেক্ষেত্রে ভারতের পক্ষে অঞ্চলটিতে সৈন্য ও সামরিক সরঞ্জাম প্রেরণ করা খুবই কঠিন হয়ে যেত। সরল ভাষায় বলতে গেলে, শিলিগুড়ি করিডোর না থাকলে খুব সম্ভবত উত্তর-পূর্ব ভারতীয় প্রদেশগুলো স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হতো।
কিন্তু মুদ্রার অপর পিঠে শিলিগুড়ি করিডোর ভারতের জন্য একটি সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা ঝুঁকি। ১৯৪৭ সাল থেকে ভারত ও পাকিস্তান পরস্পরের তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী। তখন বর্তমান বাংলাদেশের ভূখণ্ড (অর্থাৎ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান) ছিল ভারতের জন্য শত্রুরাষ্ট্রের ভূখণ্ড।
অন্যদিকে, ১৯৬০-এর দশকে চীন ভারতের তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। সেসময় ভারতীয় সমরবিশারদদের মধ্যে এই আশঙ্কা ছিল যে, যুদ্ধের সময় চীন ও পাকিস্তান উত্তর ও দক্ষিণ দিক থেকে শিলিগুড়ি করিডোরের ওপর যৌথ আক্রমণ চালাতে পারে। এই সম্ভাবনা ছিল ভারতীয় সমরবিদদের জন্য একটি ‘কৌশলগত দুঃস্বপ্ন’।
কিন্তু ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান ‘পাকিস্তান’ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এর ফলে দক্ষিণ দিক থেকে শিলিগুড়ি করিডোরের ওপর আক্রমণের সম্ভাবনা বহুলাংশে দূর হয়। এর উপরে, ১৯৭৫ সালে সিকিম ভারতের একটি প্রদেশে পরিণত হয়। এর ফলে ভারতের জন্য শিলিগুড়ি করিডোরের উত্তর দিকের নিরাপত্তা বৃদ্ধি পায়। তখন থেকে ভারতের দৃষ্টিতে শিলিগুড়ি করিডোরের নিরাপত্তার প্রতি মূল হুমকি হচ্ছে চীন।
সম্প্রতি চীনের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক উত্থানের ফলে ভারতের জন্য শিলিগুড়ি করিডোরের প্রতি নিরাপত্তা ঝুঁকির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। চীন ও শিলিগুড়ি করিডোরের মধ্যবর্তী দূরত্ব এত কম যে, চীনারা তাদের বর্তমান অবস্থান থেকেই করিডোরটির ওপর গোলাবর্ষণ করতে পারে। যুদ্ধের ক্ষেত্রে চীনা সৈন্যদের শিলিগুড়ি করিডোর আক্রমণের জন্য মাত্র ১৩০ কি.মি. দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে। এরপর তারা সর্বাত্মক আক্রমণ চালিয়ে করিডোরটি দখল করে নিতে পারবে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে সর্বাত্মক চীনা–ভারতীয় যুদ্ধ আরম্ভ হলে চীন যদি শিলিগুড়ি করিডোর দখল করতে সক্ষম হয়, সেক্ষেত্রে উত্তর-পূর্ব ভারতে বসবাসরত প্রায় ৫ কোটি ভারতীয় নাগরিক ও অঞ্চলটিতে মোতায়েনকৃত হাজার হাজার ভারতীয় সৈন্য ভারতীয় মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। এর ফলে যুদ্ধের প্রথম পর্যায়েই ভারত বড় ধরনের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে।

ভারত একটি উপায়েই শিলিগুড়ি করিডোরের ওপর তাদের মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরশীলতা হ্রাস করতে পারে। এই উপায়টি হচ্ছে উত্তর-পূর্ব ভারতে পৌঁছানোর জন্য বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করা। ২০১০-এর দশকে বাংলাদেশ ভারতকে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রদান করেছে। এটি শিলিগুড়ি করিডোরের ওপর ভারতের মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরশীলতা হ্রাস করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।
কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চিরস্থায়ী মৈত্রী বলে কিছু নেই। একটি রাষ্ট্র কখনো তার নিরাপত্তার জন্য অপর কোনো রাষ্ট্রের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়তে পারে না। এজন্য শিলিগুড়ি করিডোর মূল ভারতীয় ভূখণ্ড ও উত্তর-পূর্ব ভারতের মধ্যে মূল সংযোগ রক্ষাকারী হিসেবে বিবেচিত হতে থাকবে এবং ভারতের দুর্বল ‘চিকেন নেক’ হিসেবে বিরাজ করতে থাকবে।