Ridge Bangla

শ্রীলঙ্কা যেভাবে অর্থনৈতিক সংকট থেকে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে

মাঝে একটা সময়ে শ্রীলঙ্কা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খুবই আলোচনায় ছিল। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে লীলাভূমি এই দ্বীপদেশটি গভীর অর্থনৈতিক সংকটে মুখোমুখি হয়েছিল। এর ফলে দেশটির সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে এবং তৎকালীন সরকারের পতন ঘটায়।

সেই ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট থেকে শ্রীলঙ্কা ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, অনেকাংশে সফলও হয়েছে। যে দেশটি একসময় তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর সমৃদ্ধ সংস্কৃতির জন্য পরিচিত ছিল, ২০২০ সালে করোনাড পর  থেকে শুরু হওয়া এক অর্থনৈতিক দুরাবস্থা তাকে আন্তর্জাতিক মহলে এক নতুন পরিচয়ে পরিচিতি দেয়– এক দেউলিয়া রাষ্ট্র।

সেই সময়ে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছিল। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছিল। অত্যধিক মুদ্রাস্ফীতির ফলে জনজীবন হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ।

শ্রীলঙ্কার সেই সংকটের মূল কারণগুলো ছিল বহুমাত্রিক। কোভিড মহামারির ফলে শ্রীলঙ্কার পর্যটন শিল্পের মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। পর্যটনশিল্প ছিল দেশটির বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। এর পাশাপাশি সরকার অপরিণামদর্শী অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো চরম সংকটের দিকে এগিয়ে দিয়েছিল দেশটিকে। ব্যাপক হারে কর কমিয়ে আনা, রাসায়নিক সারের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা এবং বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পে অপ্রয়োজনীয় বিনিয়োগ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছিল।

বিদেশি ঋণের বোঝা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, দেশটি সেই ঋণ পরিশোধে অক্ষম হয়ে পড়ে। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে বিক্ষুব্ধ জনগণ রাজপথে নেমে আসে এবং দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ক্ষমতাচ্যুত করে। কিন্তু এই গভীর অন্ধকার কূপ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য শ্রীলঙ্কা সরকার ও জনগণ এক সমন্বিত প্রচেষ্টা শুরু করে।

প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (IMF) সঙ্গে একটি ৪.৯ বিলিয়ন ডলারের বর্ধিত তহবিল চুক্তি স্বাক্ষর করা। এই চুক্তি কেবল আর্থিক সাহায্যই ছিল না, বরং শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে প্রাণ ফিরিয়ে এনেছিল। পাশাপাশি এটি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ইতিবাচক বার্তা দিয়েছিল। আইএমএফের শর্তানুযায়ী শ্রীলঙ্কাকে কঠোর আর্থিক সংস্কার কর্মসূচির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে এখনও।

অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচির আওতায় সরকার একাধিক সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে। রাজস্ব আয় বাড়াতে নতুন করে কর আরোপ করা হয়েছে এবং করের ভিত্তি প্রসারিত করা হয়েছে। মূল্য সংযোজন কর (VAT) বাড়ানো হয়েছে এবং ব্যক্তি আয়কর ও কর্পোরেট করের কাঠামোতেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। ভর্তুকি হ্রাস করা হয়েছে, বিশেষ করে জ্বালানি ও বিদ্যুতে, যা প্রাথমিক পর্যায়ে জনগণের ওপর কিছুটা চাপ সৃষ্টি করলেও দীর্ঘমেয়াদে সরকারি ব্যয় নিয়ন্ত্রণে অপরিহার্য ছিল।

শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন উদ্যোগগুলোতে ব্যাপক সংস্কার আনার পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছে, যার মধ্যে কিছু রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রি বা বেসরকারিকরণের বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বিদ্যুৎ খাতের সংস্কার, যার ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় এবং সরবরাহ আরও কার্যকর হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ।

আর্থিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তারা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর মুদ্রানীতি গ্রহণ করে। সুদের হার বাড়ানো হয় এবং বাজারে তারল্য কমানোর চেষ্টা করা হয়। এর ফলস্বরূপ, একসময় যে মূল্যস্ফীতি ৭০ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল, তা এখন একক সংখ্যায় নেমে এসেছে। শ্রীলঙ্কার রুপির মানও স্থিতিশীল হয়েছে, যা আমদানি খরচ কমাতে সাহায্য করেছে। এটি তাদের বাণিজ্য ঘাটতি কমাতেও সহায়ক হয়েছে।

পর্যটন খাত, যা সংকটের সময় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তা আবারও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। আন্তর্জাতিক ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া এবং শ্রীলঙ্কার নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার কারণে বিদেশি পর্যটকদের আগমন আবার বেড়েছে। সরকার পর্যটন শিল্পকে চাঙ্গা করতে বিভিন্ন প্রচারণামূলক কার্যক্রম চালাচ্ছে।

প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহও বেড়েছে, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে সাহায্য করছে। কিন্তু এই পুনরুদ্ধারের পথ খুব সহজ নয়। সাধারণ মানুষের জীবনে সংস্কার পদক্ষেপের প্রভাব বেশ কঠিন। উচ্চ কর আরোপ এবং বিভিন্ন খাতে সরকারি ভর্তুকি হ্রাসের কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে।

কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে (SME) পুনরুজ্জীবিত করা এখনও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার হলো গৃহীত ঋণগুলো ধীরে ধীরে শোধ করা। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং সুশাসন নিশ্চিত করাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ যেকোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা পুনরুদ্ধারের গতিকে শ্লথ করতে পারে।

শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। এটি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে দুর্বল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, অদূরদর্শী নীতি এবং বাহ্যিক আঘাত একটি দেশকে কতটা গভীর সংকটে ফেলতে পারে। একইসাথে এটি প্রমাণ করে যে- সঠিক নীতি, আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং জনগণের ধৈর্য ও সহনশীলতা থাকলে কঠিন পরিস্থিতি থেকেও ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব।

তথ্যসূত্র:

১) Sri Lanka’s Economic Rebound

২) Sri Lanka: Recovery Takes Hold

৩) How is Sri Lanka recovering from its economic crisis?

এই পোস্টটি পাঠ হয়েছে: ১৩

আরো পড়ুন