Ridge Bangla

প্রথম বার্বার যুদ্ধ: ভূমধ্যসাগরে মার্কিন নৌবাহিনীর প্রথম পদার্পণ

১৮০৩ থেকে ১৮০৫ সাল অবধি যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়ে পড়ে এক নৌযুদ্ধে। তাদের প্রতিপক্ষ ছিল উত্তর আফ্রিকার উপকূলীয় কয়েকটি দেশ, যারা বার্বার রাজ্য (Barbary States) নামে পরিচিত। এর অন্যতম ছিল মরক্কো, আলজিয়ার্স, তিউনিস এবং ত্রিপোলি। মরক্কো সার্বভৌম হলেও বাকিরা নামেমাত্র উসমানী সালতানাতের প্রতি আনুগত্যের শপথে আবদ্ধ। অবশ্য এই আনুগত্য সীমিত বার্ষিক উপঢৌকন পাঠানোতেই।

তৎকালীন ভূমধ্যসাগরে জলদস্যুদের প্রবল উৎপাত। এদের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক বার্বার রাজ্যগুলো। জলদস্যুদের লুটের মালামালের একাংশ জমা পড়ে রাজকোষে, আবার বাণিজ্য জাহাজের নিরাপত্তার শর্তে বিপুল চাঁদা তোলা হয় তাদের সরকারের থেকে। অন্তর্কোন্দলে ব্যতিব্যস্ত ইউরোপ আপাতত বার্বার দস্যুদের সমূলে উৎপাটনের বদলে অর্থকড়ি দিয়ে সামলে রাখতেই আগ্রহী। যুক্তরাষ্ট্র ছিল সেই সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত।

প্রেক্ষাপট

১৭৭৬ সালে স্বাধীনতা ঘোষণা করে ব্রিটিশ শাসিত আমেরিকা। কয়েক বছর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৭৮৩ সালে পরাজয় মেনে নেয় ইংল্যান্ড, আত্মপ্রকাশ করে নতুন এক শক্তি-যুক্তরাষ্ট্র।

একটা সময় মার্কিনিদের বাণিজ্য জাহাজ রয়্যাল নেভির ছত্রছায়ায় বিশ্বজুড়ে ব্যবসা করতে পারতো। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে এই রক্ষাকবচ হারায় তারা। ব্রিটিশ কূটনীতিবাদরাও বার্বার রাজ্যগুলোকে জানিয়ে দেন রয়্যাল নেভি আর মার্কিন পতাকাবাহী জাহাজের নিরাপত্তা বিধান করবে না।

জলদস্যুদের তো পোয়াবারো! এতদিন ইউরোপিয়ান জাহাজ লুটপাট আর বন্দী নাবিকদের মুক্তিপণের অর্থে ফুলে-ফেঁপে উঠছিল তাদের কোষাগার, এখন যুক্ত হলো নতুন শিকার। ফলে ভূমধ্যসাগর দিয়ে আটলান্টিকে চলাচলে ভয়াবহ ঝুঁকিতে পরে মার্কিন ব্যবসায়ীরা।

মরক্কো

বার্বার রাজ্যগুলো মূল লক্ষ্য ছিল জলদস্যুদের ভয় দেখিয়ে সুবিধামতো শর্তে চুক্তি করা, যাতে বিপুল পরিমাণে বার্ষিক চাঁদা নিশ্চিত করা যায়। বার্বার রাজ্যগুলোর মধ্যে মরক্কোই প্রথম এই ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়। তারা বুঝতে পেরেছিল অস্থির ইউরোপের থেকে তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক অধিক সুফল বয়ে আনবে। এজন্য স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালেই ১৭৭৮ সালে মরক্কো মিত্রতার প্রস্তাব দেয়। তবে লড়াইয়ের ডামাডোলে আনুষ্ঠানিক উত্তর দিতে পারেনি মার্কিনিরা।

যুক্তরাষ্ট্রকে চাপ দিয়ে আলোচনার টেবিলে আনতে কৌশল করলেন সুলতান সিদি মোহাম্মদ (Sidi Mohammed ben Abdallah)। মার্কিন জাহাজ বেটসি (Betsey) দখল করে বন্দরে নিয়ে আসে তার লোকজন। এবার টনক নড়ল যুক্তরাষ্ট্র সরকারের। ১৭৮৬ সালে মারাকেশ চুক্তি (Treaty of Marrakesh) স্বাক্ষরের পর মরক্কোর সাথে স্থাপিত হয় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।

আলজিয়ার্স

জলদস্যুদের শক্ত ঘাঁটি আলজিয়ার্স। মরক্কোর মতো এত সহজে চুক্তিতে আগ্রহী ছিল না তারা। ১৭৮৫ সালে দুটি মার্কিন বাণিজ্য জাহাজ কব্জা করেছিল তারা। এর মধ্যেই পর্তুগালের সাথে যুদ্ধ বেধে যায় আলজিয়ার্সের। পর্তুগিজ রাজা আরোপ করেন নৌ-অবরোধ, ফলে জলদস্যুদের অবাধ চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। এই পরিস্থিতিতে মার্কিন জাহাজ নিরাপদেই চলতে থাকে। ফলে আটকে যায় আলোচনা।

১৭৯৩ সালে যুদ্ধ থেমে যায়। শান্তিচুক্তির ফলে নৌ-অবরোধ উঠিয়ে নেয় পর্তুগাল। ভূমধ্যসাগর দিয়ে চলাচলে হুমকির মুখে পড়ে মার্কিন জাহাজ। এক বছরের মধ্যে ১১টি বাণিজ্যতরী ছিনিয়ে নেয় আলজিয়ার্স, বন্দী হয় কমসেকম ১২০ জন নাবিক।

মার্কিন আইনপ্রণেতারা নৌবাহিনী শক্তিশালী করার তাগিদ অনুভব করলেন। ১৭৯৪ সালে কংগ্রেসের ভোটে এজন্য অর্থ বরাদ্দ হয়। মার্কিন নৌবাহিনীর প্রথম ছয়টি রণতরী তৈরি শুরু হয় এই টাকাতেই। তবে একটা কিন্তু রেখে দিয়েছিল কংগ্রেস। বলা হয় যদি এর মধ্যে আলজিয়ার্সের সাথে চুক্তি হয়ে যায় তাহলে স্থগিত করা হবে নির্মাণ।

মার্কিন প্রতিনিধিদল ১৭৯৫ সালে উত্তর আফ্রিকাতে পৌঁছে। কূটনীতিবিদ জোয়েল বার্লো, জোসেফ ডোনাল্ডসন আর রিচার্ড ও’ব্রায়েন আলজিয়ার্স, তিউনিস আর ত্রিপোলির সাথে চুক্তি সম্পন্ন করেন। শর্তমতে নিরাপত্তার জন্য বার্ষিক চাঁদা প্রদানে সম্মত হয় যুক্তরাষ্ট্র।

যুদ্ধের ডামাডোল

মার্কিনিরা কিন্তু রণতরী তৈরি বন্ধ করেনি, বরং কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করতে বিল পাশ করে কংগ্রেস। অল্প সময়ে পানিতে নামে তিনটি ফ্রিগেট- ইউএসএস কন্সটিটিউশন (Constitution), ইউএসএস ফিলাডেলফিয়া  (Philadelphia) আর ইউএসএস কন্সটেলেশন (Constellation)। বাকি তিন জাহাজের কাজ চলতে থাকে খানিকতা ঢিমেতালে।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য কিন্তু বার্বার রাজ্যগুলো ছিল না। ফরাসি বিপ্লবের পর বাকি ইউরোপের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে ফ্রান্স। এর আঁচ পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওপরেও। ক্যারিবিয়ানে ফরাসিরা মার্কিন জাহাজ দখল করে নেয়। এই প্রেক্ষিতে মজুত থাকা বহর সেদিকে পাঠিয়ে দেয় কংগ্রেস, বাহিনী আধুনিকায়নে নতুন করে অর্থ অনুমোদন করে তারা।

যুদ্ধের সূচনা

আলজিয়ার্সের সাথে উত্তেজনা কিন্তু কখনোই পুরোপুরি হ্রাস পায়নি। পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে ওঠে ১৮০০ সালের সেপ্টেম্বরে। বার্ষিক চাঁদা নিয়ে ইউএসএস জর্জ জাহাজে করে আলজিয়ার্সে হাজির হন ক্যাপ্টেন উইলিয়াম বেইনব্রিজ (William Bainbridge)। রাজ্যের শাসক তাকে বাধ্য করেন উসমানী সুলতানের জন্য উপহার নিয়ে কন্সট্যান্টিনোপোলে যাত্রা করতে। এই খবরে পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে কংগ্রেস।

নতুন করে ঝামেলা লাগে ত্রিপোলির সাথে। ১৮০১ সালে সেখানকার শাসক ইউসুফ (Yusuf Qaramanli) দাবি করেন সময়মতো প্রতিশ্রুত অর্থ পাননি তিনি। ক্ষতিপূরণ হিসেবে অতিরিক্ত অর্থ চাইলেন তিনি। ত্রিপোলির মার্কিন কনসাল জানিয়ে দিলেন তার সরকার এই চাহিদা পূরণ করতে রাজি নয়। ইউসুফ সাথে সাথেই যুদ্ধ ঘোষণা করেন। জবাবে ১৮০২ সালের ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসনে ভূমধ্যসাগরে নৌবহর প্রেরণের অনুমতি দেয়।

প্রাথমিকভাবে ত্রিপোলি অবরোধের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। পরিস্থিতি পাল্টে যায় ১৮০৩ সালে কমোডোর এডওয়ার্ড প্রেবলের (Edward Preble) আগমনে। দলবল নিয়ে ত্রিপোলির বন্দরের বাইরে অবরোধ জারি করেন তিনি। ৩১ অক্টোবর তার অধীনস্থ ক্যাপ্টেন বেইনব্রিজ ফিলাডেলফিয়া জাহাজ নিয়ে জলদস্যুদের একটি জাহাজের ওপর আক্রমণ করেন। দুর্ভাগ্যবশত, অগভীর সাগরে বেকায়দায় পড়ে যান তিনি, চড়ায় উঠে যায় রণতরী। ত্রিপোলির লোকেরা তাকে ঘিরে ফেললে আত্মসমর্পণে বাধ্য হন বেইনব্রিজ। ফিলাডেলফিয়া নিয়ে যাওয়া হয় বন্দরে।

প্রেবল প্রমাদ গুনলেন। ফিলাডেলফিয়া মেরামত করে নিলে তাদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অস্ত্র হয়ে উঠবে সেটা। তার নির্দেশে পরের বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি জলদস্যুদের থেকে দখল করা একটা জাহাজকে স্থানীয় বাণিজ্য জাহাজে রূপ দেয়া হয়। এরপর লেফটেন্যান্ট স্টিফেন ডেকাটোর (Stephen Decatur, Jr) একদল মেরিন সেনা নিয়ে লুকিয়ে পড়লেন সেখানে। বন্দরে প্রবেশের কৌশলে ফিলাডেলফিয়াতে উঠে পড়েন তারা। ত্রিপোলির সেনারা তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে গোলাগুলি আরম্ভ করে। তবে ফিলাডেলফিয়াতে আগুন লাগিয়ে নিরাপদেই কেটে পড়েন ডেকাটোর।

চূড়ান্ত সংঘাত

ইউসুফ নিজে ক্ষমতায় বসেছিলেন ভাই হামেতকে (Hamet Karamanli) উৎখাত করে। হামেত আলেক্সান্দ্রিয়াতে নির্বাসনে ছিলেন। মার্কিন কূটনীতিবিদ উইলিয়ান ইটন (William Eaton) তার সাথে জোটের প্রস্তাব দেন। ১৮০৫ সালের বসন্তে হামেতের ভাড়া করা ৪০০ গ্রীক আর আরব সৈনিকের সাথে যোগ দেয় মার্কিন মেরিনরা, নেতৃত্ব নেন ইটন নিজে। লিবিয়ার তপ্ত মরুভূমি পাড়ি দিয়ে ইউসুফের শাসনাধীন অন্যতম বৃহৎ শহর ডার্না (Derna) আক্রমণ করে এই বাহিনী।তীর থেকে তাদের সাহায্য করে তিনটি রণতরী- ইউএসএস নটিলাস, ইউএসএস হর্নেট আর ইউএসএস আর্গাস

২৭ এপ্রিল তিন রণতরীর যুগপৎ বোমাবর্ষণে ভেঙ্গে পড়ে শহরের প্রতিরক্ষা। ইটনের লোকজন এরপর দ্রুত শহরে ঢুকে পড়ে। হতোদ্যম প্রতিরক্ষা বাহিনী অল্পক্ষণ লড়াইয়ের পর পালিয়ে যায়।

ইটন যখন ডার্না দখল করা শেষ করেছেন তখনই উপস্থিত হয় ইউসুফের পাঠানো সহায়ক সেনাদল। বেশ কয়েকবার শহর পুনর্দখলের চেষ্টা করে পিছিয়ে আসতে হয় তাদের। ইটন এবার ত্রিপোলিতে অভিযানের পরিকল্পনা করতে থাকলেন।

সমাপ্তি

সংঘাতের আড়ালে কিন্তু আলোচনা জারি ছিল। মার্কিন কর্মকর্তা লিয়ার (Tobias Lear) আর ড্যানিশ কনসাল নিকোলাস নিসেন (Nicholas C. Nissen) ইউসুফের সাথে সমঝোতা করতে সমর্থ হন। রফা হয় যে এককালীন ৬০,০০০ ইউএস ডলার ত্রিপোলির হাতে তুলে দেবে মার্কিনিরা, এরপর অতিরিক্ত কোনো অর্থ দিতে হবে না। চুক্তির ফলে ইউসুফ রয়ে গেলেন ত্রিপোলির ক্ষমতায়, অন্তত দ্বিতীয় বার্বার যুদ্ধ অবধি।

References
এই পোস্টটি পাঠ হয়েছে: ১২

আরো পড়ুন