ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর আগ্রাসন সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার প্রয়োজন পড়ে না। ইন্টারনেটে হাজার হাজার ভিডিও ক্লিপ কিংবা ছবি পাওয়া যায়, যেগুলোতে ছোট বাচ্চাদের নিথর দেহ, সন্তানের লাশ হাতে বাবা-মায়ের আহাজারি, প্রবল শক্তিশালী বোমাবর্ষণে বড় বড় দালানের ধুলোয় মিশিয়ে দেয়ার বর্বরতা তুলে ধরা হয়। বাস্তবে গাজার অধিবাসীদের জীবন আরও অনেক বেশি অনিশ্চিত। মাথায় মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে তাদের বেঁচে থাকতে হয় প্রতিটা মুহুর্ত।
ইসরায়েল যে যুদ্ধনীতির অনুসরণে ফিলিস্তিনের গাজা, ইয়েমেন কিংবা লেবাননের বেসামরিক মানুষের উপর এ ধরনের তীব্র আগ্রাসন চালায়, সেটা পরিচিত ‘দাহিয়া ডকট্রিন’ নামে।
দাহিয়া ডকট্রিনের ইতিহাস জানতে হলে আমাদের একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে। দাহিয়া আসলে লেবাননের বৈরুতের পাশের একটি উপশহর। এখানে লেবাননের শিয়াপ্রধান আধাসামরিক বাহিনী হিজবুল্লাহর বেশ কিছু হেডকোয়ার্টার ছিল।
২০০৬ সালে তেত্রিশ দিনের টানা আক্রমণে দাহিয়াকে একরকম ধুলোয় মিশিয়ে দেয় ইসরায়েলি বাহিনি। সেই সামরিক আগ্রাসনে লেবাননের বারোশরও অধিক মানুষ প্রাণ হারান, যাদের বেশিরভাগই ছিল নারী ও শিশু। ইসরায়েলের আক্রমণ শুধু এই উপশহরেরই সীমাবদ্ধ ছিল না। বাণিজ্যিক বন্দর, বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাতেও হামলা চালিয়ে স্বাভাবিক নাগরিক জীবনকে চরমভাবে ব্যাহত করা হয় সেসময়।
ইসরায়েল যাদের শত্রু মনে করে, তাদের উপর নিয়মিতই এই ডকট্রিন বা মতবাদ অনুসরণ করে অসম আক্রমণ চালানো হয়, যে আক্রমণের মূল লক্ষ্য থাকে বেসামরিক জনগণ, এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। লেবাননের দাহিয়া শহরের নামে পরবর্তীতে এই ডকট্রিনের নাম রাখা হয় ‘দাহিয়া ডকট্রিন’।

যার পরিকল্পনায় ২০০৬ সালে দাহিয়া ডকট্রিন হাতে নেয়া হয়েছিল তিনি ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর নর্দার্ন কমান্ডের জেনারেল গাদি আইজেনকোট। ২০০৮ সালে লেবাননের সাথে ভবিষ্যতের কোনো যুদ্ধ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি মন্তব্য করেন, “২০০৬ সালে দাহিয়ায় যা হয়েছে, ভবিষ্যতে যেসব জায়গা থেকে ইসরায়েলে আক্রমণ করা হবে, সেসব জায়গার একই পরিণতি হবে। আমরা সেসব গ্রামে অসম সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে দ্বিধাবোধ করবো না। এটা কোনো পরামর্শ নয়, এটা একটা পরিকল্পনা। ইতোমধ্যেই এই পরিকল্পনা অনুমোদিত হয়েছে।”
মূলত এটাই ছিল দাহিয়া ডকট্রিনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা। তবে ২০০৬ সালের আগেও ইসরায়েল অনেকবার অসম আগ্রাসনের মাধ্যমে বেসামরিক মানুষ ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার উপর হামলা চালিয়েছে।
২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাসের সাথে ইসরায়েলের নতুন করে যে সশস্ত্র সংঘাতের সূচনা হয়, সেই সংঘাতের ফলে এখন পর্যন্ত পর্যন্ত মারা গিয়েছেন ৫০ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি, যাদের এক উল্লেখযোগ্য অংশই নারী ও শিশু।
গাজার বসবাস করা প্রায় তেইশ লাখ মানুষের বেশিরভাগই বাস্তুহারা। ধারণা করা হচ্ছে, এখনও দশ হাজারেরও বেশি মানুষের লাশ উদ্ধার করা যায়নি, যারা ধ্বংসস্তুপের নিচে চাপা পড়েছেন।

শুধু এবারই নয়, ২০০৯, ২০১৪ কিংবা ২০১৮ সালেও ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী এই যুদ্ধনীতির প্রয়োগ ঘটিয়েছে ফিলিস্তিনে। লেবাননে ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকেই ইসরায়েলি বিমান হামলা চলছে। এমনই এক হামলায় হিজবুল্লাহর সাবেক প্রধান হাসান নাসরাল্লাহ মৃত্যুবরণ করছেন। লেবাননে এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন দুই হাজারের বেশি মানুষ। আহতের সংখ্যাও ছাড়িয়েছে দশ হাজার।
আন্তর্জাতিক আইনে ইসরায়েলের এই নৃশংস যুদ্ধনীতির কোনো বৈধতা খুঁজে পাওয়া যায় না। এমন অসম (Disproportionate) আক্রমণ এবং বেসামরিক নাগরিক ও স্থাপনার উপর চালানো হামলাকে আন্তর্জাতিক আইনে সরাসরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আইন অনুযায়ী, বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি কোনোভাবেই অত্যধিক হওয়া যাবে না, এবং বেসামরিক জনগণের ক্ষতি যেন কমিয়ে আনা যায় সেই লক্ষ্যে হামলার আগে যথাযথ পূর্বপ্রস্তুতি নিতে হবে।
এছাড়া ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব রেডক্রসের মতে, বেসামরিক জনগণ ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রক্ষার ক্ষেত্রে যেকোনো সশস্ত্র সংঘাতের ক্ষেত্রে ‘আনুপাতিকতা’ অনুসরণ করা অত্যন্ত জরুরি, অর্থাৎ যেকোনো সামরিক লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে বেসামরিক জনগণ ও বেসামরিক স্থাপনার ক্ষেত্রে প্রয়োজনের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করা যাবে না।
আন্তর্জাতিক আইনে যা-ই বলা থাকুক না কেন, প্রতিপক্ষের উপর নৃশংস হামলা চালানোর ক্ষেত্রে ইসরায়েল বরাবরই এসব থোড়াই কেয়ার করে এসেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো অসংখ্যবার ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক আইনভঙ্গ কিংবা যুদ্ধাপরাধের কথা বললেও সেগুলো আদতে ইসরায়েলকে থামাতে পারেনি।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বর্তমানে বৈশ্বিক সংগঠনগুলোকে আরও বেশি শক্তিশালী করার কথা উঠে আসলেও আন্তর্জাতিক আইনের মারপ্যাচে পড়ে আদতে কোনো লাভ হচ্ছে না। দিনশেষে ইসরায়েলের এই যুদ্ধনীতি মানবতার জন্য নিদারুণ ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই বয়ে আনেনি।
তথ্যসূত্র:
৩) The Dahiya doctrine, proportionality, and war crimes – Palestine Studies