Ridge Bangla

চীন-তাইওয়ান সংকট

আমরা সাধারণত চীন বলতে একটি দেশকেই বুঝে থাকি। তবে অন্তত সাংবিধানিক নামের দিক থেকে চিন্তা করলে বর্তমানে ‘চীন’ নামে অন্তত দুটি দেশ আছে। একটি People’s Republic of China বা গণপ্রজাতন্ত্রী চীন। অন্যটি Republic of China, বা প্রজাতন্ত্রী চীন। প্রজাতন্ত্রী চীন দেশটিকে আমরা তাইওয়ান নামেই ডেকে থাকি। তবে এটা আদতে কোনো ‘রাষ্ট্র’, নাকি চীনের প্রদেশ, সেটা নিয়ে আছে বিতর্ক।

চীন মনে করে- তাইওয়ান চীনের একটি পবিত্র ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু তাইওয়ানের নিজস্ব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা, নির্বাচিত সরকার, পৃথক সামরিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা রয়েছে। দেশটির বর্তমান সরকার এবং তরুণ জনসাধারণের একটা বড় অংশ নিজেদের আলাদা সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবেই চিন্তা করে। এর পেছনে আছে ঐতিহাসিক বাস্তবতা।

ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, চীনের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূল থেকে ১০০ মাইল দূরত্বে অবস্থান করা তাইওয়ান দ্বীপে মূলত স্থানীয় আদিবাসীদের বাস ছিল কয়েক শতক ধরে। দ্বীপটি চীনা সাম্রাজ্যের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে সপ্তদশ শতকে। ১৮৯৫ সালে সাইনো-জাপানিজ প্রথম যুদ্ধে চিং সাম্রাজ্যের পরাজয় হলে তাইওয়ান জাপানের একটি উপনিবেশে পরিণত হয়।

Image source: Kayak

১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয় ঘটলে দ্বীপটির মালিকানা ফিরে পায় চীন। এবার চীনের শাসনক্ষমতায় ছিলেন জাতীয়তাবাদী নেতা জেনারেল চিয়াং কাই শেক। এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চীনের মূল ভূখণ্ডে মাও সে তুংয়ের কমিউনিস্ট পার্টি এবং জাতীয়তাবাদী কুওমিনট্যাংয়ের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৪৯ সালে মাও সে তুং গৃহযুদ্ধে জয়ী হয়ে দেশটিতে কমিউনিস্ট শাসন শুরু করেন।

অন্যদিকে চিয়াং কাই শেকের অধীনে থাকা কুওমিনট্যাং তাইওয়ানে পালিয়ে যায় এবং প্রজাতন্ত্রী চীন রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয়। চিয়াং কাই শেক স্বপ্ন দেখতেন একদিন পুনরায় সম্পূর্ণ চীনের মূল ভূখণ্ড দখলে নেওয়ার। তবে আট দশক পর বর্তমান বাস্তবতা ভিন্ন। এখন আর তাইওয়ানিজরা সম্পূর্ণ চীনের ভূখণ্ড নিয়ে আগ্রহ দেখায় না।

তবে এই সংকট দীর্ঘায়িত হওয়াতে জটিলতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। জাতীয়তাবাদীরা তাইওয়ানে পালিয়ে যাওয়ার পর তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র শুরুতে চীন বলতে মূলত তাইওয়ানকেই স্বীকৃতি দিয়েছিল। জাতিসংঘেও চীন হিসেবে সদস্য ছিল মূলত তাইওয়ান।

সত্তরের দশকে চীন-সোভিয়েত দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নকে মোকাবেলার জন্য কমিউনিস্ট চীনের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে নিক্সন-কিসিঞ্জারের যুক্তরাষ্ট্র। তখন কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করায় তাইওয়ানকে চীনের অংশ হিসেবে মেনে নিতে হয় যুক্তরাষ্ট্রকে। তবে অনানুষ্ঠানিকভাবে তাইওয়ানকে আলাদা রাষ্ট্রের মতো করেই দেখে আসছে যুক্তরাষ্ট্র।

এক্ষেত্রে তারা ‘কৌশলগত অস্পষ্টতা’ নীতি অবলম্বন করে। এতে কোনো প্রকার স্বীকৃতি না দিয়েও তাইওয়ানকে বাণিজ্যিক ও সামরিক সহায়তা দিয়ে আসছে তারা। আমেরিকান ইন্সটিটিউট ইন তাইওয়ান মূলত একটি ডিফ্যাক্টো দূতাবাস হিসেবে কাজ করে। ওয়াশিংটন ‘ওয়ান চায়না’ নীতি অনুসরণ করলেও তাইওয়ানে চীনের সার্বভৌমত্বের বিষয়টি স্বীকার করে না।

Image source: Getty Images

জাতীয়তাবাদীরা তাইওয়ানে পালিয়ে যাওয়ার পর কয়েক দশক দুই অঞ্চলের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করলেও আশির দশক থেকে পরোক্ষভাবে ব্যবসা, বিনিয়োগ এবং সীমিত আকারে যোগাযোগ বৃদ্ধি পেতে থাকে। সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা চূড়ান্ত পর্যায়ে যায় যখন ২০১৫ সালে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট মা ইং জিউ এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সিঙ্গাপুরে প্রথমবারের মতো ঐতিহাসিক বৈঠক করেন।

তবে ২০১৬ সালে স্বাধীনতাপন্থী ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টির সাই ইং-ওয়েন তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে চীন-তাইওয়ান সম্পর্ক আবার তিক্ততায় রূপ নেয়। চীন এরপর থেকে নিয়মিতই সমুদ্রপথে মহড়া দিয়ে আসছে। তাইওয়ানও চীনের আক্রমণ প্রতিহত করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। চীন সম্প্রতি তাইওয়ান প্রসঙ্গে ‘শান্তিপূর্ণ পুনর্মিলন’ নীতি প্রত্যাহার করেছে। তারা এখন প্রয়োজনে বল প্রয়োগের নীতি অবলম্বন করেছে। ২০১৩ সালে চীনের সামরিক বাজেট যেখানে ছিল ৭২০ বিলিয়ন ইউয়ান, সেখানে শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বে ২০২৪ সালে বাজেট দাঁড়িয়েছে ১.৬৭ ট্রিলিয়নে, যা দ্বিগুণেরও বেশি।

Image source: TSMC

তাইওয়ান নিয়ে চীনের কঠোর অবস্থানের পেছনে কেবল সার্বভৌমত্বই নয়, ভূরাজনৈতিক ও বৈশ্বিক আধিপত্যের বিষয়ও জড়িত। তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচার কোম্পানি (TSMC) বৈশ্বিক চিপ উৎপাদনের ৫৫ শতাংশ বাজার দখল করে আছে। এই ক্ষুদ্র দ্বীপ অঞ্চলের একটি কোম্পানি পুরো বিশ্বের জন্যই তাই গুরুত্বপূর্ণ একটি সম্পদে পরিণত হয়েছে। তাইওয়ান সম্পূর্ণরূপে চীনের অধীনে চলে আসলে এই চিপ কোম্পানিও চীনের অধীনে চলে আসবে। এতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের যে প্রতিযোগিতা চলছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয় ঘটবে। তাই যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি না দিলেও যেকোনো মূল্যে তাইওয়ানের স্বাধীনতা রক্ষায় তৎপর।

২০২২ সালে রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করলে তাইওয়ান প্রসঙ্গটি আবার আলোচনার তুঙ্গে আসে। রাশিয়া যেভাবে ইউক্রেনের অঞ্চলগুলো দখল করে নিয়েছে, চীনও একইভাবে তাইওয়ান আক্রমণ করে দখল করে নিলে যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের হয়ে সহায়তা করতে আদৌ আসবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র সহায়তা, সামরিক প্রশিক্ষণ কিংবা আর্থিক সহায়তা দিলেও সরাসরি নিজেদের সেনা পাঠায়নি কিংবা ন্যাটোকে জড়িত করেনি। একইভাবে তাইওয়ানকেও চীনের আক্রমণের সামনে সহায়তা না করলে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বস্ততা নিয়ে বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর সন্দেহের উদ্রেক ঘটবে।

চীন ২০২৭ সালের মধ্যে তাইওয়ানে আক্রমণের সক্ষমতা অর্জন করতে চায়। অবশ্য এর একটা ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হয় যে চীন ২০২৭ সালেই তাইওয়ান আক্রমণ করে দখলে নিয়ে নেবে। বিষয়টি আসলে তেমন নয়। আক্রমণ করা আর আক্রমণের সক্ষমতা অর্জন করা, দুটি ভিন্ন বিষয়। তবে তাইওয়ান নিয়ে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে নিকট ভবিষ্যতের দিনগুলোতে উত্তেজনা বিরাজ করার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।

আরো পড়ুন