ব্যাবিলন—প্রাচীন পৃথিবীর বিখ্যাত এক শহর, যেখানে ইতিহাস আর কল্পনা মিলেমিশে তৈরি করেছে এক বিস্ময়কর জগৎ। ইউফ্রেটিস নদীর তীরে বিস্তৃত এই নগরী শুধু ইট ও পাথরের শহর নয়, বরং ছিল জ্ঞান, রাজনীতি, ধর্ম ও সংস্কৃতির এক জীবন্ত মহাসমারোহ। ঝুলন্ত উদ্যানের মত বিস্ময়, জিগুরাতের মত ধর্মীয় স্থাপনা, হাম্মুরাবির আইনসংহিতার মতো সুবিবেচিত শাসনব্যবস্থা, সব মিলিয়ে ব্যাবিলন ছিল সভ্যতার এক সিংহদ্বার, যা ইতিহাসের পাতায় চিরকালই সমহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে থাকবে।
ব্যাবিলনের ধ্বংসাবশেষ বর্তমান ইরাকের বাগদাদ শহর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। এই শব্দটি এসেছে আক্কাদীয় বাব-ইল (অর্থ—‘দেবতার দরজা’) থেকে, যা গ্রিক ভাষায় ব্যাবিলন রূপে পরিচিত।
গ্রিক ঐতিহাসিকেরা ব্যাবিলনের বর্ণনা দিয়েছেন বিস্ময়ভরা শ্রদ্ধায়। এখানেই ছিল প্রাচীন পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্য ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান। তবে বাইবেলে ব্যাবিলন চিত্রিত হয়েছে অহংকার ও পতনের প্রতীক হিসেবে। ‘বাবেলের মিনার’ থেকে শুরু করে রেভেলেশন অধ্যায় পর্যন্ত ব্যাবিলনের নাম জড়িয়ে আছে ভয় ও ধ্বংসের উপমা হয়ে।

শুরুতে এটি ছিল ইউফ্রেটিস নদীর তীরে গড়ে উঠা ছোট এক বন্দর শহর। পরবর্তীতে আক্কাদীয় ও আমোরীয় শাসকদের হাত ঘুরে সুমু-আবুম ও তাঁর উত্তরসূরি সুমু-লা-ইলু প্রতিষ্ঠা করেন ব্যাবিলনের প্রথম রাজবংশ। তখনও শহরটি ছিল তুলনামূলকভাবে ছোট।
সম্রাট হাম্মুরাবি

ব্যাবিলনের প্রকৃত উত্থান ঘটে সম্রাট হাম্মুরাবির হাত ধরে। কৌশলে তিনি লারসা সাম্রাজ্য জয়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেন এক বিস্তৃত সাম্রাজ্য, যার রাজধানী ছিল ব্যাবিলন। সম্রাট হাম্মুরাবি আইনব্যবস্থা গঠনে অসাধারণ দক্ষতা দেখান। তিনি বিশ্বের প্রাচীনতম আইনসংহিতাগুলোর একটি প্রণয়ন করেন, যা “চোখের বদলে চোখ” নীতির ওপর ভিত্তি করে তৈরি। হাম্মুরাবির মৃত্যুর প্রায় এক শতাব্দী পর হিত্তিরা ব্যাবিলন আক্রমণ করে এবং শহরটির উপর থেকে প্রাচীন ব্যাবিলনীয় শাসনের অবসান ঘটায়। হিত্তিদের পতনের পর ক্যাসাইটরা খ্রি.পূ. ১৫৩১ অব্দে ব্যাবিলন দখলের পর দীর্ঘ সময় ধরে শাসন করে। তবে এ সময় ব্যাবিলন তার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধরে রাখতে সক্ষম হয়।
নব্য-ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যের উত্থান
খ্রিষ্টপূর্ব ৯১২ সালে শুরু হওয়া অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্য ধ্বংস হয় নাবোপলাসরের নেতৃত্বে। খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৬ অব্দে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন নব্য-ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্য। এটি ছিল ব্যাবিলনের ইতিহাসে এক নবজাগরণের সূচনা। তাঁর পুত্র নেবুচাদনেজার দ্বিতীয় ছিলেন এই যুগের উজ্জ্বলতম চরিত্র, যাঁর শাসনে ব্যাবিলন পরিণত হয় এক গুরুত্বপূর্ণ নগরীতে। তাঁর আমলে নির্মিত হয় সুরক্ষিত নগরপ্রাচীর, বিশাল প্রাসাদ, রাজকীয় মন্দির ও কিংবদন্তির সেই ঝুলন্ত উদ্যান। নব্য-ব্যাবিলনীয় যুগে হাম্মুরাবির সময়কার শাসননীতির ছায়া পুনরায় ফিরে আসে। শহরের নান্দনিকতা ও প্রশাসনিক কাঠামো নতুন মাত্রা পায়। সম্রাট নাবোনিদাসের শাসনকাল এই ধারাকে আরও দৃঢ় করে তোলে। প্রাচীন ধর্মীয় কাঠামো ও মন্দিরসমূহ পুনর্নির্মাণে তিনি ব্যতিক্রমী ভূমিকা রাখেন।
পারস্যের দখল ও পরিবর্তনের সূচনা
নব্য-ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্য যখন রাজনৈতিকভাবে দুর্বল, ঠিক তখনই খ্রি.পূ. ৫৩৯ সালে পারস্য সম্রাট সাইরাস দ্য গ্রেট অপিসের যুদ্ধে জয়ী হয়ে ব্যাবিলনের দিকে অগ্রসর হন। শহরের শক্ত প্রাচীর অতিক্রম করতে তিনি বেছে নেন এক কৌশলী পন্থা। ইউফ্রেটিস নদীর প্রবাহ বদলে তার স্তর কমিয়ে ফেলা হয়, আর সৈন্যরা সেই নদীপথ দিয়েই শহরে প্রবেশ করে। লোকবিশ্বাসে প্রচলিত, এই জয় ছিল রক্তপাতহীন। যদিও ইতিহাস ঘাঁটলে আংশিক ক্ষতির উল্লেখ পাওয়া যায়।

পারস্য যুগে ব্যাবিলনের পুনঃমর্যাদা
সাইরাস ও তাঁর উত্তরসূরিরা ব্যাবিলনকে শুধু জয়ই করেননি, তাঁরা এই নগরকে দিয়েছিলেন পূর্ণ সম্মান। পারস্য সাম্রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে ব্যাবিলনের গুরুত্ব অব্যাহত থাকে। খ্রি:পূ: ৫৩৯ অব্দে ব্যাবিলন দখলের পর সাইরাস দ্য গ্রেট তার ‘সাইরাস সিলিন্ডার’-এ ব্যাবিলনের দেবদেবীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দেন, যা ইতিহাসের প্রথম মানবাধিকার ঘোষণাগুলোর একটি হিসেবে বিবেচিত। এ সময় ব্যাবিলনের বিখ্যাত মন্দির ‘এসাগিলা’ পুনর্নির্মাণ ও সংস্কার করা হয়। এছাড়া জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত ও সাহিত্যচর্চার জন্য ব্যাবিলন আবারও একটি জ্ঞানের কেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে। এখানে গড়ে ওঠে এক নতুন সহাবস্থানের পরিবেশ, যেখানে ধর্ম, জ্ঞান ও সংস্কৃতি ছিল রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় লালিত।
জ্ঞান ও বিজ্ঞানের উত্তরাধিকার
প্রাচীন ব্যাবিলন কেবল সাম্রাজ্য বা ধর্মীয় আচার নয়, জ্ঞান-বিজ্ঞান বিকাশের ক্ষেত্রেও ছিল এক অনন্য কেন্দ্র। তারা ষাটভিত্তিক সংখ্যাপদ্ধতি ব্যবহার করে গাণিতিক সূত্র, বর্গমূল, ঘনমূল ও পিথাগোরাসীয় উপপাদ্যের প্রয়োগ জানত, যা সময় পরিমাপ ও জ্যামিতিতে এখনও ব্যবহৃত হয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানে ব্যাবিলনীয়রা সূর্য-চন্দ্র গ্রহণ, গ্রহের গতি ও ঋতুচক্রের হিসাব রাখত। এসবের বিশদ বিবরণ তারা “এনুমা আনু এনলিল” নামক গ্রন্থে তা লিপিবদ্ধ করে, যা পরবর্তী গ্রিক ও ইসলামি জ্যোতির্বিজ্ঞানে গভীর প্রভাব ফেলে। চিকিৎসাশাস্ত্রেও তারা রোগ নির্ণয়, ঔষধপ্রয়োগ ও চিকিৎসকের পেশাগত নিয়মাবলিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে, যা হাম্মুরাবির আইনসংহিতায়ও স্থান পায়। ব্যাবিলনীয়রা পৃথিবীকে নদীর নদীপথ ও অঞ্চল চিহ্নিত করে প্রাচীন বিশ্বের মানচিত্র “ইমাগো মুন্ডি” তৈরি করে। সব মিলিয়ে ব্যাবিলন ছিল জ্ঞান, বিজ্ঞান ও সভ্যতার এক উজ্জ্বল দীপ্তি।
.jpg?mtime=1504910742)
ব্যাবিলন শুধু একটি নগরীই নয়, এটি ছিল সভ্যতার আলোচক, জ্ঞানস্তম্ভ ও সংস্কৃতির প্রতীক। ইতিহাসের নানা উত্থান-পতনের মধ্যেও সে জ্বেলে রেখেছিল আপন আলো। সাম্রাজ্য বদলেছে, শাসক পাল্টেছে, তবু ব্যাবিলনের নাম রয়ে গেছে মহাকালের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা। এই নগরী আজও প্রমাণ করে, সত্যিকার গৌরব কখনো মুছে যায় না।
তথ্যসূত্র
১। Babylon | History, Religion, Time Period, & Facts | Britannica
২। Babylon – World History Encyclopedia