একবিংশ শতাব্দীর বিশ্ব রাজনীতিতে যখন বড় শক্তিগুলোর প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা চলছে, তখন ধীরে ধীরে এই খেলার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে আফ্রিকা মহাদেশ। একটা সময় যে আফ্রিকাকে কেবল ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর সংঘাতের প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখা হতো, সেই আফ্রিকাই আজ ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের এক নতুন ময়দান। দুইশো বছর আগেও যে মহাদেশটি সম্পর্কে বাকি বিশ্বের কোন ধারণাও ছিল না, তাদেরকে ঘিরেই ভূরাজনীতির পরবর্তী ময়দান গড়ে উঠছে। খনিজ সম্পদ, তরুণ জনগোষ্ঠী আর অফুরন্ত অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কারণে বিশ্বের পরাশক্তিগুলো এখন আফ্রিকায় তাদের অবস্থান পাকা করতে মরিয়া। একে এক ধরনের ‘নতুন সাম্রাজ্যবাদ’ বা ‘নয়া স্নায়ুযুদ্ধ’ বললেও হয়তো ভুল হবে না।
ইউরোপীয় উপনিবেশিক কাল অবসানের পর আফ্রিকা দীর্ঘদিন ধরেই পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাব বলয়ে ছিল। কিন্তু গত দুই দশকে এই নাট্য অনেকখানি বদলে গেছে। এই পরিবর্তনের প্রধান অনুঘটক চীন। ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (BRI)-এর আওতায় চীন আফ্রিকা জুড়ে বন্দর, রাস্তা, রেলপথ এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো বিশাল সব অবকাঠামো নির্মাণে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। চীনের এই ‘বিনিয়োগ কূটনীতি’র মূল আকর্ষণ হলো- তারা কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বা মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে না। ফলে, অনেক আফ্রিকান দেশের কাছেই চীনের এই ‘শর্তহীন’ সহায়তা পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। এর বিনিময়ে চীন আফ্রিকার বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ, যেমন তেল, তামা, কোবাল্ট—নিজেদের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির জোগান হিসেবে নিশ্চিত করেছে।
চীনের এই অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা দেখে নড়েচড়ে বসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ইউরোপীয় মিত্ররা। তারা বুঝতে পারছে যে, আফ্রিকায় চীনের প্রভাব বাড়তে থাকলে তা কেবল অর্থনৈতিকভাবেই নয়, বরং কৌশলগতভাবেও তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। এর জবাবে যুক্তরাষ্ট্র ‘প্রসপার আফ্রিকা’র মতো উদ্যোগ নিয়েছে, যার লক্ষ্য আফ্রিকায় মার্কিন বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানো। তবে তাদের মূল লক্ষ্য থাকে গণতন্ত্র, সুশাসন এবং নিরাপত্তার ওপর, যা চীনের চেয়ে ভিন্ন।
যুক্তরাষ্ট্র বোঝানোর চেষ্টা করছে যে, চীনের ঋণের ফাঁদে পড়ে আফ্রিকার দেশগুলো তাদের সার্বভৌমত্ব হারাতে পারে। আবার এই চীন-মার্কিন দ্বন্দ্বের মধ্যেই নিজের জায়গা করে নিতে চাইছে রাশিয়া। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আফ্রিকা থেকে প্রায় হারিয়ে যাওয়া রাশিয়া এখন আবার নতুন করে ফিরে এসেছে। তাদের মূল শক্তি হলো নিরাপত্তা ও সামরিক সহযোগিতা। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে যেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা রয়েছে, সেখানে রাশিয়া অস্ত্র সরবরাহ, সামরিক প্রশিক্ষণ এবং ভাড়াটে সেনা (যেমন ওয়াগনার গ্রুপ) পাঠিয়ে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করছে। ইউক্রেন যুদ্ধের পর আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে হয়ে পড়া রাশিয়া আফ্রিকার দেশগুলোর সমর্থন আদায় করে জাতিসংঘে নিজের পক্ষে একটি শক্তিশালী বলয় তৈরির চেষ্টাও দৃশ্যমান।
এর ফলে যা হয়েছে, তা হলো পুরোনো ঔপনিবেশিক শক্তি, যেমন ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য, তাদের ঐতিহাসিক প্রভাব ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। বিশেষ করে পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে ফরাসি-বিরোধিতা বাড়ছে এবং সেসব জায়গায় রাশিয়া ও চীন দ্রুত শূন্যস্থান পূরণ করছে। এর পাশাপাশি তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ভারতের মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলোও পিছিয়ে নেই। তুরস্ক তার সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সাদৃশ্যকে কাজে লাগিয়ে আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোতে প্রভাব বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে ভারত বাণিজ্য ও তথ্য-প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে নিজের অবস্থান জানান দিচ্ছে।
তবে এই ভূ-রাজনৈতিক খেলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আফ্রিকার দেশগুলোর নিজস্ব ভূমিকা। তারা এখন আর পশ্চিমা বা প্রাচ্যের শক্তির হাতের পুতুল হয়ে থাকতে রাজি নয়। আফ্রিকার নেতারা বুঝতে শিখেছেন কীভাবে এক শক্তিকে অন্য শক্তির বিরুদ্ধে ব্যবহার করে নিজেদের জন্য সবচেয়ে লাভজনক চুক্তি আদায় করে নিতে হয়। তারা নিজেদের মহাদেশীয় স্বার্থ রক্ষায় ‘আফ্রিকান কন্টিনেন্টাল ফ্রি ট্রেড এরিয়া’ (AfCFTA)-এর মতো উদ্যোগ গ্রহণ করছে, যা তাদের দর-কষাকষির ক্ষমতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
সব মিলিয়ে, আফ্রিকা আজ এক জটিল ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণের কেন্দ্র। একদিকে যেমন বিদেশি বিনিয়োগের ফলে মহাদেশটির উন্নয়নের এক বিশাল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তেমনই অন্যদিকে রয়েছে ঋণের বোঝা, সম্পদের লুণ্ঠন এবং পরাশক্তিদের প্রক্সি যুদ্ধের ক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি। এই প্রতিযোগিতাপূর্ণ বিশ্বে আফ্রিকার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তার নেতারা কতটা বিচক্ষণতার সঙ্গে নিজেদের পথ তৈরি করতে পারেন, তার ওপর। বিশ্ব এখন তাকিয়ে আছে, ভূরাজনীতির এই নতুন ময়দানে আফ্রিকা কি নিজের ভাগ্য নিজেই গড়তে পারবে, নাকি আবারও পুরনো খেলার নতুন শিকার হবে?
তথ্যসূত্র:
১) Why Africa will become a prominent player in global geopolitics
২) Africa as the theater of a new proximity war between Russia and the Western bloc? Part 1
৩) Africa’s Geopolitical Recalibrations in a Multipolar World