Ridge Bangla

জীবনানন্দ দাশ: আমৃত্যু দুঃখময়তায় কাটানো এক উদাসী কবি

বাংলা সাহিত্যে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব কতখানি, তা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। যে সময়ে বিশ্বসাহিত্যে বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যকর্মগুলো ছিল পুরোপুরি অবহেলিত, সেসময়ে তার ‘গীতাঞ্জলি’ তাকে নোবেল পুরষ্কার এনে দিয়েছিল। বাংলা সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি অবদান রেখেছেন। তিনি এতটাই প্রভাবশালী যে, তার নামে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি যুগ রয়েছে।

১৯০০ থেকে ১৯৪০ পর্যন্ত সময়ের ব্যাপ্তিকে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘রবীন্দ্র যুগ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এই যুগের কবিদের মাঝে রবীন্দ্রনাথের কাব্যধারা অনুসরণের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু এই যুগের কবি হয়েও রবীন্দ্রনাথকে অনুসরণ করার কোনো প্রয়োজন বোধ করেননি একজন কবি। বুঝতে পেরেছেন কার কথা বলছি? জি, তিনি জীবনানন্দ দাশ।

জীবনানন্দ দাশের ব্যক্তিজীবন ছিল বিভিন্ন সংকটে পরিপূর্ণ। কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের আগপর্যন্ত তার জীবন সুন্দরভাবে অতিবাহিত হলেও পরিণত হওয়ার পর সংকট ঘনীভূত হতে শুরু করে। কখনও প্রচন্ড অর্থ সংকটে স্বাভাবিক জীবনযাপন করাও কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে, আবার কখনও পেশাগত জীবন নাকি কবিতা লেখার নেশা– কোনটা গুরুত্ব দেবেন তা নিয়ে নিজের সাথেই মনোজাগতিক লড়াই করতে হচ্ছে।

মাঝে বেশ কয়েকবার জীবনে স্বস্তির সময় এলেও নানা কারণে তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ব্যক্তিজীবনের দুর্দশা কাটাতে কবিতা লিখলেও সেই কবিতা যে কবিকে খ্যাতি বা সম্মানের চূড়ায় নিয়ে গিয়েছে– এমনটাও নয়। বলাই বাহুল্য, নিজের জীবদ্দশায় জীবনানন্দ দাশ তার কবিতার সঠিক মূল্যায়নও পাননি। তার যে খ্যাতি, তার কবিতা যে বাংলা সাহিত্যে অনন্য– এই বিষয়গুলো সম্পর্কে মানুষ জানতে পেরেছে তার মৃত্যুর বেশ পরে।

জীবনানন্দ দাশ

১৯১৯ সালে কলকাতার বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্স শেষ করার পর মাস্টার্স ডিগ্রি লাভের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু মাস্টার্স পরীক্ষার ঠিক আগে আগে অসুস্থ হয়ে পড়েন। রক্ত আমাশয়ের কারণে তিনি দুর্বল হয়ে পড়েন, যার প্রভাব পড়ে পরীক্ষার ফলাফলে। দ্বিতীয় বিভাগ নিয়ে মাস্টার্স শেষ করেন তিনি। পরবর্তী জীবনে মাস্টার্সের খারাপ ফলাফলের প্রভাব পড়েছিল।

লেখক শাহাদুজ্জামান ‘একজন কমলালেবু’ নামে জীবনানন্দ দাশের একটি জীবনীগ্রন্থ রচনা করেন। সেখানে দেখা যায়, চাকরি চলে যাওয়ার পর বেকারত্বের সময়ে জীবনানন্দ দাশ বিভিন্ন জায়গায় চাকরির জন্য দরখাস্ত করলেও মাস্টার্সের ফলাফলের জন্য তাকে হতাশ হতে হয়। তার স্ত্রী লাবণ্য দাশ স্কুলে শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করে পরিবারকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করেন।

সিটি কলেজে সাহিত্যের শিক্ষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তার পেশাগত জীবন শুরু হয়। কিন্তু পরবর্তীতে ধর্মীয় উৎসব উদযাপনকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের মাঝে অসন্তোষ দেখা দেয়। এই অসন্তোষের ফলশ্রুতিতে সেই কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা অনেক কমে যায়। এতে অর্থসংকটে পড়ে কলেজটি। একপর্যায়ে স্কুলের কর্তৃপক্ষ শিক্ষক ছাঁটাই করতে শুরু করলে জীবনানন্দ দাশের চাকরি হারান। যেহেতু তিনি ছিলেনে কলেজের কনিষ্ঠতম শিক্ষকদের একজন, তাই চাকরি চলে যাওয়াটা একপ্রকার অবধারিতই ছিল। এই ঘটনার আকস্মিকতায়  জীবনানন্দ দাশ বেশ কষ্ট পেয়েছিলেন। হঠাৎ করে বেকার হয়ে যাওয়া জীবনানন্দ দাশের বেকার জীবন শুরু হয়, যা তাকে জীবনের সবচেয়ে নির্মম বাস্তবতাগুলো উপলব্ধি করায়।

কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের আগে তিনি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কবিতা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু এসব কবিতা তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি। তিনি যেহেতু একজন অখ্যাত কবি ছিলেন, তাই তার কবিতাগুলো একত্র করে বই হিসেবে প্রকাশ করার ব্যাপারেও কোনো প্রকাশক আগ্রহী ছিলেন না।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

১৯২৭ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরাপালক’ প্রকাশিত হয়। তিনি তার কবিতা সম্পর্কে সেই সময়ের প্রধান কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূল্যায়ন জানার জন্য কাব্যগ্রন্থের এক কপি প্রেরণ করেন। রবিঠাকুর ‘ঝরাপালক’ সম্পর্কে উদাসীন মন্তব্য করেন ও কাব্যের ভাষা সম্পর্কে সমালোচনা করেন, যা জীবনানন্দকে হতাশ করে। কিন্তু তারপরেও তিনি দমে যাননি। নিজের মতো করে কবিতা রচনা চালিয়ে যান। অপরদিকে সজনীকান্ত দাস ও নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী কড়া ভাষায় তার সমালোচনা করেন। তাদের সমালোচনার ভাষা এত তীব্র ছিল যে, অন্য কবি হলে হয়তো কবিতা লেখাই বন্ধ করে দিতেন।

যুবক বয়সে জীবনানন্দ তার আত্মীয়া শোভনার প্রেমে পড়েন। তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক চললেও তা শেষ পর্যন্ত স্থায়ী কোনো সম্পর্কের রূপ নেয়নি। এ নিয়ে কবি নিজেও অত্যন্ত হতাশ ছিলেন। ধারণা করা হয়, তার কবিতায় বনলতা সেন কিংবা সুরঞ্জনার মতো নারী চরিত্রগুলোর মধ্যে তার একসময়ের প্রেমিকা শোভনার ছায়া দেখতে পাওয়া যায়।

জীবনানন্দ দাশ ও তার স্ত্রী লাবণ্য দাশ

এছাড়াও দাম্পত্যজীবনে তার স্ত্রী লাবণ্য দাশের সাথেও সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ ছিল না। এর কারণ বিয়ের পর তার স্ত্রী অনেক আশা নিয়ে তার গৃহে আসলেও পরবর্তীতে জীবনানন্দের চাকরি চলে যাওয়ার পর বেকার জীবনের দুর্দশা অত্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব ফেলে তাদের সম্পর্কে। মৃত্যুর পর ট্রাঙ্কের ভেতর জীবনানন্দের অনেকগুলো উপন্যাস ও গল্প পাওয়া যায়, যেগুলোতে সাংসারিক জীবনের যাঁতাকলে পিষ্ট বধূর হতাশায় জর্জরিত জীবনের গল্প বর্ণিত হয়েছে। ধারণা করা হয়, জীবনানন্দ দাশ তার এবং লাবণ্যর দাম্পত্যজীবনের গল্পই এই উপন্যাসগুলোতে তুলে ধরেছেন।

রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী কবি জীবনানন্দের জীবন নানা বিয়োগান্তক ঘটনায় পরিপূর্ণ। মৃত্যুর পর একটি ট্রাঙ্ক পাওয়া যায়, যেখানে তার অসংখ্য লেখা পাওয়া গিয়েছিল। পরবর্তীতে দেখা যায়- তার মোট লেখালেখির মাত্র এক-তৃতীয়াংশ প্রকাশিত হয়েছিল। বাকিগুলো কখনোই প্রকাশ করেননি তিনি। ব্যক্তিজীবন নানা দুঃখ-দুর্দশায় জর্জরিত থাকলেও কবিতায় যেভাবে চিত্ররূপময়তাকে তুলে ধরেছেন, তা যেন প্রকৃতিকে একেবারে জীবন্ত করে তুলে ধরে পাঠকের সামনে। স্বীয় সৃষ্টির মাধ্যমে আরও অনেক বছর পাঠকের মনে বেঁচে থাকবেন জীবনানন্দ দাশ৷

তথ্যসূত্র

১) জীবনানন্দ দাশ: হৃদয়ের কাছাকাছি যার বসবাস

২) জীবনানন্দ: আছে দুঃখ আছে মৃত্যু

৩) একজন কমলালেবু: শাহাদুজ্জামান

আরো পড়ুন