Ridge Bangla

অপরাধ ও দুর্নীতির মাস্টারমাইন্ড সাবেক আইজিপি বেনজীর

সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। অভিযোগগুলো শুধু তার একক আচরণ নয়, বরং এটি দেশের প্রশাসনিক এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জবাবদিহিতার সংকটকেই সামনে নিয়ে এসেছে।

বেনজীর আহমেদ সীমাহীন অপরাধ করেছেন

বিচার বহির্ভূত হত্যা, গুম, খুন, দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ মাথায় নিয়ে বিদেশে পালিয়ে থাকা বাংলাদেশের সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদকে ধরতে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ অর্গানাইজেশনের (ইন্টারপোল) মাধ্যমে ‘রেড নোটিস’ জারি করা হয়েছে। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক ছিলেন বেনজীর। এর আগে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তিনি ছিলেন র‍্যাবের মহাপরিচালক। বাংলাদেশের কোনো সাবেক পুলিশ প্রধানের বিরুদ্ধে রেড নোটিস জারির ঘটনা এই প্রথম। এরপর বেনজীর ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে এক ডজনের বেশি দুর্নীতির মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। এছাড়া বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বিচার বহির্ভূত হত্যা, গুম, খুনে তার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ নিয়েও তদন্ত চলছে।

তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে আগে থেকেই লোকমুখে আলোচনা ছিল। তবে ২০২৪ সালের মার্চে সংবাদপত্রে তার সম্পদ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে বিষয়টি নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দেয় আদালত। আমরা তার মানবতাবিরোধী দেশদ্রোহী অপরাধের কিছু অংশ সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

দুর্নীতি

বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় হলো দুর্নীতির অভিযোগ; অবৈধভাবে বিপুল সম্পদ অর্জন এবং সেই সম্পদের উৎস গোপন রাখা। দুদকের অনুসন্ধানে জানা যায়, তার পরিবারের নামে ঢাকার বাইরে রয়েছে প্রায় ১৪০০ বিঘা জমি, যেখানে নির্মিত হয়েছে ইকো রিসোর্ট ও পর্যটন প্রকল্প। এছাড়া বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, পাঁচ তারকা হোটেলের শেয়ার, এবং বিদেশে (যেমন: সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাই) বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকানার তথ্যও পাওয়া গেছে। কিন্তু এসব সম্পদের কোনো বৈধ আয় বা উৎস দেখাতে পারেননি তিনি।

অর্থ পাচার ও বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ড

২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুদক বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী ও দুই কন্যার নামে ১১ কোটি টাকার সম্পদ পাচারের অভিযোগে মামলা দায়ের করে। এরপরই তিনি দেশত্যাগ করেন, এবং ধারণা করা হয়, তিনি বর্তমানে স্পেনে অবস্থান করছেন। তার বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ রয়েছে যে, তিনি আইজিপি থাকা অবস্থায় ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো গুরুতর অপরাধে জড়িত ছিলেন, যার মধ্যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগও রয়েছে। এছাড়া হত্যা, খুন, গুম, নির্যাতনের সাথে তিনি জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি

দুর্নীতির অভিযোগে আদালতের আদেশে বাংলাদেশ পুলিশ ইন্টারপোলের কাছে রেড নোটিশ জারির আবেদন করে। ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে ইন্টারপোল বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করে, যদিও এটি তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়নি। বাংলাদেশ পুলিশ ই-মেইলের মাধ্যমে নিশ্চিত করে যে, ইন্টারপোল বিষয়টি অনুমোদন করেছে। রেড নোটিশ মূলত একটি আন্তর্জাতিক নির্দেশনা, যা একজন পলাতককে সনাক্ত ও আটক করার জন্য বিশ্বব্যাপী আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সহযোগিতা নিশ্চিত করে।

বেনজীরের অপরাধের প্রতিক্রিয়া

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং সংবাদমাধ্যমে বেনজীর আহমেদ বারবার দাবি করেছেন, তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ ‘নির্জলা মিথ্যা’। তিনি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছেন, কেউ যদি প্রমাণ দিতে পারে যে তিনি কোনো অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন, তাহলে তিনি সেই সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে লিখে দেবেন। তবে এসব দাবির পরেও তিনি দুদকের ডাকে সাড়া না দিয়ে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ায় তার বক্তব্যের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।

সামাজিক প্রতিক্রিয়া ও গুরুত্ব

একজন পুলিশ বাহিনীর প্রধানের বিরুদ্ধে এমন গুরুতর অভিযোগ ওঠা শুধু সমাজকে নাড়িয়ে দেয়নি, বরং প্রশাসনিক ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়েও প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। পুলিশ, প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থার শীর্ষ পদে থাকা ব্যক্তিরা যদি দুর্নীতিতে লিপ্ত হন, তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে আইন ও বিচার ব্যবস্থা নিয়ে আস্থার সংকট তৈরি হয়।

সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত ও উপযুক্ত বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়া জরুরি। কারণ, এটি কেবল একজন ব্যক্তির বিচার নয়, এটি রাষ্ট্রের ন্যায়ের প্রতি দায়বদ্ধতা ও প্রশাসনের স্বচ্ছতা প্রমাণের একটি পরীক্ষা। জনমতের চাপ, সাংবাদিকদের অনুসন্ধান এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যক্রমের ফলে যেভাবে তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে, তা আশা জাগায় যে, অবশেষে হয়তো এই দেশে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা সম্ভব।

আরো পড়ুন