Ridge Bangla

সবার আগে বাংলাদেশ: তারেক রহমানের চোখে রাজনীতি, সংস্কার ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে দীর্ঘ ১৭ বছর পরে  প্রথমবারের মতো গণমাধ্যমের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি বিবিসি বাংলার সঙ্গে একাধিক বিষয় নিয়ে স্বচ্ছভাবে মতামত পোষণ করেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিবিসি বাংলার সম্পাদক মীর সাব্বির ও সিনিয়র সাংবাদিক কাদির কল্লোল।

দুই পর্বে বিভক্ত সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় ও শেষ পর্বে উঠে এসেছে তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের মূল্যায়ন, সংস্কার, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক, সাংবাদিকতা ও সামাজিক মাধ্যমের ভূমিকা।

অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক নির্বাচনের প্রত্যাশা

তারেক রহমান জানান, বর্তমানে যে সরকার দেশের দায়িত্ব পালন করছে, সেটি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা উচিত। তিনি বলেন, “আমরা চাই এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সফল হোক। মূলত কিছু সংস্কারের মাধ্যমে একটি স্বাভাবিক, সুষ্ঠু ও স্বাধীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া জরুরি। আমাদের প্রত্যাশা, তারা এটি সুন্দরভাবে সম্পন্ন করবে।”

যে প্রশ্ন উঠেছিল, অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে সন্দেহ আছে কি না, সেটির জবাবে তারেক রহমান বলেন, “প্রাথমিক সময়ে নির্বাচনের রোডম্যাপ স্পষ্টভাবে জানানো হয়নি। ফলে বিভিন্ন মিডিয়া ও বিশ্লেষকরা সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। তবে ড. ইউনূসের রোডম্যাপ ঘোষণা এবং দৃঢ় অবস্থান গ্রহণের মাধ্যমে এই সন্দেহ অনেকাংশে দূর হয়েছে।”

লন্ডনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকের প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন, সেই সময় স্বাভাবিকভাবে সৌজন্যমূলক কথাবার্তা হয়েছে। এছাড়া তিনি বলেন, “জনগণ যদি আমাদের সুযোগ দেয়, আমরা দেশের জন্য কী পদক্ষেপ নেবো, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দেশের মানুষকে নিয়ে ভবিষ্যতের পরিকল্পনাও আমরা শেয়ার করেছি।”

অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্ষমতা

এক এগারোর সরকার বা ইন্টেরিম সরকারের পারফরমেন্স সম্পর্কে তিনি বলেন, “একটি দেশ পরিচালনা করা সহজ নয়। জনসংখ্যার ভিত্তিতে বাংলাদেশ অনেক বড়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চেষ্টা করেছে, তবে সীমাবদ্ধতাও আছে। সব ক্ষেত্রে সফল হওয়া সম্ভব নয়। তবে যেটুকু সম্ভব, তারা চেষ্টা করছেন।”

তিনি আরও বলেন, সরকারের এই প্রচেষ্টা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সরকারের দিক থেকে যে প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে, তা দেশের জন্য ইতিবাচক বলে তিনি মনে করেন।

অতীত থেকে শিক্ষা বিএনপির রাজনৈতিক লক্ষ্য

তারেক রহমান এক এগারোর সরকার বা সেনা সমর্থিত সরকারের সময়কে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও অসৎ উদ্দেশ্যপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “সেই সরকার দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিল। বিএনপি দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য নিয়ে কাজ করেছে, যা ছিল গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা।”

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, “সেই সময় দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমাদের পদক্ষেপ ছিল। পরবর্তীতে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে দেশ ধীরে ধীরে খাদ্যে স্বয়ংসিদ্ধ হয়ে ওঠে এবং স্বল্প পরিমাণ হলেও রপ্তানি শুরু হয়। এছাড়া বিএনপির সময় প্রবাসীরা বিদেশে যায় এবং গার্মেন্টস শিল্পের প্রসার ঘটে, যা দেশের অর্থনীতির শক্তিশালী ভিত্তি।”

তিনি ভবিষ্যতের বিএনপির পরিকল্পনাও তুলে ধরেন। “গণতন্ত্রের শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং জনগণের কল্যাণ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হবে। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের পথ নির্ধারণ করা হবে।”

নেতৃত্বের পরিবর্তন প্রবাস জীবনের প্রভাব

গত ১৭ বছর প্রবাসে থাকা এবং সময় ও দূরত্বের ব্যবধানকে তিনি চ্যালেঞ্জ হিসেবে বর্ণনা করেন। “আমার পরিবার স্ত্রী ও সন্তান যদি সহযোগিতা না দিত, এটি সম্ভব হতো না। নেতাকর্মীরাও দলের সংগঠন এবং জনগণের দাবির জন্য সহায়তা করেছেন।” তিনি যুক্তরাজ্যের অভিজ্ঞতা থেকে দেশের জন্য ভালো কিছু করার পরিকল্পনার কথাও শেয়ার করেন।

কূটনীতি প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক

বিএনপির কূটনীতির মূলনীতি সম্পর্কে তিনি বলেন, “সবার আগে বাংলাদেশ। দেশের স্বার্থ ও জনগণের কল্যাণ সর্বোচ্চ।” ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের প্রসঙ্গে তারেক রহমান বলেন, “বাংলাদেশের স্বার্থ সর্বোচ্চ। আমাদের পানি, সীমান্ত ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত সব বিষয়ে ন্যায্য হিস্যা চাই। অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বার্থের ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে।” তিনি স্পষ্ট করেন, “ফেলানী হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনায় আমরা কোনোভাবেই চুপ থাকব না। দেশের মানুষের ওপর আঘাত সহ্য করা যাবে না।”

সংস্কার ৩১ দফা প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন

বিএনপি বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে কাজ করছে। তারেক রহমান বলেন, “একজন ব্যক্তি একসাথে তিনটি পদে থাকবেন না। এটি স্বৈরাচারি হবে। এ ধরনের ধারণা গণতন্ত্রের বিপরীত। বিএনপি নোট অফ ডিসেন্ট দিয়েছে, কারণ গণতন্ত্রে মতপার্থক্য স্বাভাবিক।” তিনি আরও বলেন, “৩১ দফার মধ্যে যেগুলোতে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলোকে প্রথমে বাস্তবায়ন করা হবে। এছাড়াও যেগুলো ঐকমত্যে নেই, সেগুলোও যথাসাধ্যভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। বিএনপি সরকারের প্রতিশ্রুতিকে জনগণের জন্য বাস্তবায়ন করবে।”

প্রাণী পরিবেশ বিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টি

রাজনীতির বাইরে তিনি পশুপ্রেম ও পরিবেশ সচেতনতার কথাও উল্লেখ করেন। তারেক রহমান বলেন, “আমাদের ছোটবেলা থেকে প্রাণীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। পোষা বিড়াল, কুকুর, হাঁস-মুরগি, পাখি! সবই আমাদের জীবন ও প্রকৃতির সঙ্গে জড়িত। মানুষকে প্রকৃতির সঙ্গেই মানিয়ে চলতে হবে। বনায়ন ও সবুজাভ অঞ্চল বৃদ্ধির গুরুত্ব অপরিসীম। এটি না করলে মানুষের বসবাস কঠিন হয়ে যাবে।”

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মত প্রকাশ

সোশ্যাল মিডিয়ায় মিম বা কার্টুন নিয়ে তিনি হাসিমুখে মন্তব্য করেন, “আমি এগুলো উপভোগ করি। তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভ্রান্তি ও মিথ্যা তথ্য ছড়ানো নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে। ফ্যাক্ট চেক অপরিহার্য।”

সংবাদমাধ্যম মত প্রকাশের স্বাধীনতা

তারেক রহমান আশ্বাস দেন, “বিএনপি ক্ষমতায় এলে সংবাদমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। অতীতে বিএনপি শাসনের সময় সাংবাদিকদের কোনো নির্যাতন বা দমন ঘটেনি। ভবিষ্যতেও এটি নিশ্চিত করা হবে।” তিনি বলেন, কালো আইন বা সীমাবদ্ধতা ধাপে ধাপে সংস্কার করা হবে। তবে গণমাধ্যম ও জনগণের সচেতনতা অপরিহার্য।

ভবিষ্যতের পরিকল্পনা আস্থা পুনঃস্থাপন করা

৫ই আগস্ট ২০২৪-এর রাজনৈতিক  পরিবর্তনের পর তারেক রহমান জানান, বিএনপি দেশের মানুষের আস্থা অর্জনের জন্য ইতিবাচক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। অতীতের শিক্ষা নিয়ে যেন কোনো সরকার স্বৈরাচারী না হয়ে উঠতে পারে। দেশের জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস,  যেখানে জনপ্রতিনিধি দ্বারা পরিচালিত হবে।

তিনি উদাহরণ দেন অভিজ্ঞ চালকের মাধ্যমে যাত্রার। যেমন- অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দল দেশের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করবে। “ভুল-ত্রুটি সম্ভব, তবে অভিজ্ঞতা ও প্রতিশ্রুতির আলোকে আমরা সঠিক পথে কাজ চালাবো।” তিনি আরও বলেন, “ভবিষ্যতের বিএনপি জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দেশের স্বার্থ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। গণতন্ত্র, জবাবদিহিতা ও মানুষের কল্যাণ কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে।”

প্রায় ১৭ বছর  পর এই সাক্ষাৎকারে তারেক রহমান স্পষ্টভাবে জানান, বিএনপি দেশের স্বার্থ, জনগণের কল্যাণ এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবে। সরকারের পারফরমেন্স, রাজনৈতিক সংস্কার, কূটনীতি, সামাজিক দায়িত্ব এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা- এগুলো বিএনপির পরিকল্পনার কেন্দ্রে থাকবে। বাংলাদেশী জনগণের স্বার্থ সর্বোচ্চ রেখে দলের কর্মসূচি বাস্তবায়নে তিনি দৃঢ় প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।

এই পোস্টটি পাঠ হয়েছে: ২১

আরো পড়ুন