বাংলাদেশের বহুল আলোচিত স্বপ্নের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) ৮৫ পাতার একটি গোপন প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে, যা উদ্বেগজনক নিরাপত্তা ঘাটতি উন্মোচন করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কেন্দ্রটির যন্ত্রপাতি অপূর্ণ, জরুরি পরিস্থিতিতে কার্যকর প্রতিক্রিয়ার ব্যবস্থা অনিশ্চিত এবং বিকিরণ নিয়ন্ত্রণে গাফিলতি অব্যবস্থাপনা বিদ্যমান।
আইএইএ-এর বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা ও কমিশনিং সম্পন্ন না হলে ফুয়েল লোডিং শুরু করা ভয়াবহ দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। সংস্থার ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রেস নোটে ‘কমিটমেন্ট, ইমপ্রুভমেন্ট, ইনহ্যান্সমেন্ট’ শব্দগুলো উল্লেখ থাকলেও বাস্তবতায় নিরাপত্তার মানদণ্ড পূর্ণ হয়নি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, রূপপুরে নন-নিউক্লিয়ার টেস্টের ধাপ সম্পূর্ণ হয়নি। প্রকল্পে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা পরীক্ষা— প্রাইমারি সার্কিট, কন্টেইনমেন্ট, বায়োলজিক্যাল শিল্ডিং, ফুয়েল পেলেট, ও ফুয়েল রড ক্ল্যাডিং, এবং সাপোর্ট সিস্টেম যেমন কমপ্রেসড এয়ার, ওয়াটার পিউরিফিকেশন, স্ট্যান্ডবাই পাওয়ার, এইচভিএসি (HVAC) সিস্টেমের কার্যকারিতা এখনও যাচাই করা হয়নি। এছাড়া ইন্সট্রুমেন্টেশন এন্ড কন্ট্রোল সিস্টেম, রেডিয়েশন মনিটরিং, ফায়ার প্রটেকশন, নিউট্রন ফ্লাক্স মনিটরিং, হিউমিডিটি লিক মনিটরিংসহ গুরুত্বপূর্ণ বহু সিস্টেম ইনস্টলেশন অসম্পূর্ণ।
আইএইএ-এর স্টেজ প্রোগ্রাম অনুযায়ী, A0 থেকে D ধাপ পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে ১৭৪৬টি স্টার্টআপ অ্যান্ড অ্যাডজাস্টমেন্ট ওয়ার্ক (SAW) সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। বাস্তবে মাত্র ১৭১টি কাজ সম্পন্ন হয়েছে, যা কমিশনিং প্রক্রিয়াকে সংকটাপন্ন করছে। কোল্ড রান এবং হট রান পরীক্ষাও অসম্পূর্ণ, ফলে নিউক্লিয়ার ফুয়েল লোডের আগে সেফটি সিস্টেমের তথ্য অসম্পূর্ণ। ৫৩-৫৬ পৃষ্ঠায় আইএইএ উল্লেখ করেছে, জরুরি পরিকল্পনা ও প্রতিক্রিয়ার ব্যবস্থা এখনও অপ্রস্তুত। বিদ্যুৎকেন্দ্রে থাকা জরুরি সুবিধাগুলো নির্মাণাধীন এবং জরুরি দল সর্বদা প্রস্তুত নয়। প্ল্যান্টে ডিজেল জেনারেটর, ফিল্টারযুক্ত ভেন্টিলেশন, পানি সরবরাহ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ঠিকমতো স্থাপন হয়নি।
৫৯ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, দুর্ঘটনা ব্যবস্থাপনাও ভয়াবহ অব্যবস্থার শিকার। আংশিক টেবিল-টপ অনুশীলন ছাড়া কর্মীরা পূর্ণাঙ্গ ড্রিল পরিচালনা করেননি, ফলে শিফট হস্তান্তর, তথ্য হস্তান্তর ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় কার্যকর হয়নি। ৪৪ নম্বর পৃষ্ঠায় আইএইএ সতর্ক করেছে, রূপপুরের তেজস্ক্রিয় বিকিরণ সুরক্ষা ব্যবস্থা গুরুতর ঘাটতি বহন করছে। রেডিওলজিক্যাল নিয়ন্ত্রিত এলাকায় কর্মস্থল পর্যবেক্ষণ অর্ধেকমাত্র কার্যকর এবং নতুন জ্বালানি ভবনের পর্যবেক্ষণও অসম্পূর্ণ।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই অবস্থায় রূপপুরকে নির্ভরযোগ্যভাবে চালু করা বা ফুয়েল লোড করা বিপজ্জনক। স্টেজ প্রোগ্রামে বাকি থাকা কাজ সম্পন্ন না করে সরাসরি ফুয়েল লোডিং করলে বিকিরণজনিত পরিস্থিতি জটিল হবে এবং নিউক্লিয়ার অপারেশনে সরাসরি ঝুঁকি তৈরি হবে। রূপপুরের নিরাপত্তা ঘাটতি ও অসম্পূর্ণ কমিশনিং আন্তর্জাতিক সতর্কতা জারি করেছে, যা দেশীয় এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্যও গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করতে পারে।