বলিউডের কিং খান শাহরুখ খানের নাম বিশ্বজোড়া পরিচিত। জনপ্রিয়তা, পরিশ্রম আর মানুষের ভালোবাসায় তিনি বিশ্বের অন্যতম ধনী তারকা। কিন্তু বাংলাদেশেও আছেন আরেকজন ‘কিং খান’—তিনি শাজাহান খান। শোবিজে নয়, দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির জগতে তার পরিচিতি। তবে তার আর্থিক শক্তি এসেছে বৈধ আয়ের বাইরে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, দখল ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও টানা আটবার সংসদ সদস্য (মাদারীপুর-২, সদর-রাজৈর) হিসেবে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিলেন শাজাহান খান। পাশাপাশি তিনি ছিলেন নৌপরিবহনমন্ত্রী। এ সময় পরিবহন খাত ও বিআইডব্লিউটিএতে নিজের ক্যাডার বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। ভাই ও আত্মীয়দের মাধ্যমে মাদারীপুরের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তার একক আধিপত্য গড়ে ওঠে। জমি দখল, কমিশন বাণিজ্য, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি।
২০০৯ সাল থেকে পরিবহন খাতে প্রতি যানবাহনে ৭০ টাকা চাঁদা ধার্য করা হয়। এর মধ্যে ৪০ টাকা যেত মালিক সমিতির হাতে, ১০ টাকা শ্রমিক ইউনিয়ন, ১০ টাকা ফেডারেশনের হাতে, আর বাকি ১০ টাকা রাখা হতো সড়ক শৃঙ্খলা রক্ষায়। এর বাইরে উঠত অপ্রকাশ্য চাঁদা। সংশ্লিষ্টদের হিসাবে, বছরে অন্তত ১,৮৮৫ কোটি টাকা চাঁদা আদায় হতো। এভাবে মাদারীপুর ও ঢাকায় বিপুল সম্পদ ও শক্তি অর্জন করেন শাজাহান খান।
শ্রমিক নেতা হিসেবেও পরিচিত তিনি। ২০১৩ সালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন মঞ্চ, ২০১৫ সালে শ্রমিক-কর্মচারী-পেশাজীবী ও মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদ গঠন করেন। তবে এসব সংগঠনের মাধ্যমে অমুক্তিযোদ্ধাদের টাকার বিনিময়ে সনদ দেওয়ার অভিযোগও ওঠে।
তার প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে সার্বিক কনস্ট্রাকশন, সার্বিক শিপিং লাইন চট্টগ্রাম, সার্বিক ইন্টারন্যাশনাল হোটেল, সার্বিক পেট্রোল পাম্প। সার্বিক পরিবহন নামে তার মালিকানাধীন গাড়ি চলাচল করে দুই শতাধিক। নৌমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি মাদারীপুরে প্রায় ৩ হাজার কর্মীকে বিভিন্ন দফতরে চাকরি দেন। প্রতিটি চাকরির বিনিময়ে ৮–১২ লাখ টাকা নেওয়া হতো বলে অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়োগ বাণিজ্যের দায়িত্বে ছিলেন তার বিশেষ সহকারী রণজিৎ বণিক।
২০০৮ সালে শাজাহান খানের বার্ষিক আয় ছিল ৬ লাখ ৮৫ হাজার টাকা, যা ১৫ বছরে বেড়ে ৩২ গুণ হয়। একই সময়ে তার অস্থাবর সম্পদ বেড়ে পাঁচ গুণ বৃদ্ধি পায়। তখন তার সম্পদের পরিমাণ ছিল প্রায় ৪১ লাখ টাকা, যার মধ্যে দুটি বাস, একটি গাড়ি, একটি মাইক্রোবাস ও ১৫ ভরি সোনা ছিল। বর্তমানে তার ও পরিবারের নামে রয়েছে কৃষিজমি, অকৃষিজমি, ভবন ও ফ্ল্যাট মিলিয়ে কোটি কোটি টাকার সম্পদ।
মাদারীপুর পৌরসভায় বিভিন্ন ওয়ার্ডে তার মালিকানাধীন বহুতল ভবন, হোটেল, রেস্তোরাঁ ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নামেও বিভিন্ন এলাকায় বিপুল সম্পদ গড়ে উঠেছে।
সম্প্রতি ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর শাজাহান খান ও তার পরিবার আত্মগোপনে চলে যান। ৫ সেপ্টেম্বর ধানমন্ডি থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ২৬ সেপ্টেম্বর বিমানবন্দর থেকে তার ছেলে আসিবুর রহমান খানকেও গ্রেপ্তার করা হয়। সরকার পতনের দিন বিকালে তার বিলাসবহুল ১০ তলা ভবনে অগ্নিসংযোগ করা হয়, যাতে পরিবারের অন্যান্য ভবন, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও হোটেল-রেস্তোরাঁ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
শাজাহান খানের ঘটনাপ্রবাহ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারের এক উদাহরণ। পরিবহন খাত থেকে চাঁদাবাজি, শ্রমিক নিয়োগে দুর্নীতি এবং বিপুল সম্পদ অর্জন—সবই তার পরিচয়ের অংশ। তবে সাম্প্রতিক গ্রেপ্তার ও তদন্ত তার বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে নতুন মোড় এনেছে।