রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরলে দেখা যাচ্ছে চাল-ডাল, তেল, পেঁয়াজ, রসুন, মসলা, সবজি, ডিম, মুরগি ও মাছসহ শাক-সবজির দাম প্রায় প্রতিদিনই পরিবর্তিত হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে দাম কমার বদলে বেড়ে যাচ্ছে। বাজারে যেকোনো পণ্যের নির্দিষ্ট কোনো দামের নিশ্চয়তা নেই। আজকে কম তো কাল বেশি, এক পণ্যের দাম এক দোকানে যা, অন্য দোকানে তার চেয়ে বেশি।
সবজির বাজারেও এমন পরিস্থিতি নিয়মিত দেখা যাচ্ছে। গত সপ্তাহে যেসব সবজি ৫০-৬০ টাকা মধ্যে পাওয়া গেছে, সেগুলোর দাম এখন এক লাফে বেড়ে ৭০-৮০ টাকা ছুঁয়েছে। এদিকে ডিমের মূল্য কয়েকদিন কম থাকলেও তা আবার ঊর্ধ্বগতির দিকে যাচ্ছে। দেশের নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের আমিষের চাহিদা পূরণকারী ব্রয়লার মুরগির দামও স্থিতিশীল নয়। থেকে থেকে প্রায়শই ওঠা-নামা করছে।
রামপুরার বাসিন্দা হোসনে আরা বেগমের সাথে কথা বললে তিনি জানান, মাসের শুরুতে বাজার করতে গিয়ে দেখি আগের বাজেটের সাথে মিলছে না। আগে যে দামে প্রয়োজনীয় পণ্যগুলো কিনতাম, এখন সেগুলোর অর্ধেকও কেনা যাচ্ছে না।
এমন অবস্থায় বাজারে কেন- জানতে চাইলে খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, পাইকারি বাজার থেকেই দামে ভিন্নতা আসছে। অনেক সময় পণ্য আসা কমে যায়, আবার কোনো কোনো সময়ে পরিবহন সমস্যার কারণে সরবরাহ বিঘ্ন ঘটে। এছাড়া প্রকৃতির দুর্যোগেও বাজারদরে প্রভাব ফেলে। যার ফলে প্রতিদিনই দামের ব্যবধান তৈরি হয়।
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্রমবর্ধমান মূল্য। মানুষ প্রতিদিন বাজারে যেসব জিনিস কিনে সংসার চালায় তার দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। কখনো তো দিনেই কয়েক দফা দাম বেড়ে যাচ্ছে। শাক-সবজি, চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ থেকে শুরু করে ডিম-মুরগি সবকিছুতেই দেখা যাচ্ছে দাম বৃদ্ধির প্রতিচ্ছবি। এই অবস্থায় নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষরা প্রতিনিয়ত চরম চাপে পড়ছেন।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধির পেছনে অনেকগুলো কারণ কাজ করছে। প্রথমত, সরবরাহ শৃঙ্খল বা চেইনে ব্যাঘাত দেখা দেয়া। বাংলাদেশে কৃষিপণ্য এখনো পুরোপুরি সংরক্ষণযোগ্য নয়। এর ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা মৌসুমের পরিবর্তনের সময় সরবরাহ ব্যাপকভাবে কমে যাচ্ছে। এতে বাজারে পণ্যের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে, যা দাম বাড়ার অন্যতম একটি কারণ।
দ্বিতীয়ত, পরিবহন খরচের ঊর্ধ্বগতি। বিশেষ করে বর্তমান বিশ্বে যুদ্ধ-যুদ্ধ এক সাজ বিরাজমান থাকায় জ্বালানি তেলের বাজার স্থির হতে পারছে না। এতে বৃদ্ধি পাচ্ছে জ্বালানি তেলের মূল্য। এই মূল্য বৃদ্ধির ফলে প্রভাব পড়ছে দেশের অভ্যন্তরীন পরিবহন ব্যবস্থাতেও। দাম বৃদ্ধির কারণে বাজারে পণ্য পৌঁছাতে আগের চেয়ে খরচ বেশি হচ্ছে। যার ফলে পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে আর এতে করে বিক্রেতারাও বেশি দামে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।
তৃতীয়ত, আমদানি নির্ভর পণ্যগুলোর ক্ষেত্রে ডলারের বিনিময় হার বাড়ার ফলে সরাসরি দাম বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে ডাল, তেল ও মসলার মতো নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যগুলো আমদানি নির্ভর হওয়াতে ডলারের দাম বেড়ে গেলে বাজারে এসব পণ্যের দামও বেড়ে যায়। এছাড়া দেশের বাজারে গোপন সিন্ডিকেট ও কারসাজির বিষয়টি আরো গুরুতর। এই সিন্ডিকেটকেই বলা চলে দেশের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ার পেছনে বড় কারণ। দেশের ছোট-বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো গোপন সমঝোতার মাধ্যমে পণ্যের অভাব দেখিয়ে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন হরহামেশাই। এর ফলে রাতের ব্যবধানে পণ্যের দাম দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ পর্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে।
যেহেতু আমাদের দেশের বাজারে শক্তিশালী কোনো নজরদারি ব্যবস্থা নেই, তাই তারা ইচ্ছেমতো দাম ঠিক করে। জনগণও নিরুপায় হয়ে কিনতে বাধ্য হয়। এভাবে ভোক্তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। এছাড়াও নিয়মিত মনিটরিং এবং কঠোর মোবাইল কোর্ট পরিচালনার অভাবও দাম নিয়ন্ত্রণে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা একটি জটিল কাজ হলেও তা অসম্ভব নয়। প্রথমত, সরকারের উচিত সরবরাহ চেইন আধুনিকীকরণ ও সংরক্ষণ প্রযুক্তি উন্নয়নের মাধ্যমে কৃষিপণ্যের ক্ষয়-ক্ষতি কমানো। মৌসুমের বাইরে পণ্যের সঠিক স্টক মজুত রাখাও জরুরি।
দ্বিতীয়ত, পরিবহন খরচ কমানোর জন্য জ্বালানি তেলের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে হবে। যানজট কমানোর জন্য সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। যাতে অল্প সময়ের ব্যবধানেই নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলো দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শহরে আসতে পারে।
তৃতীয়ত, বাজারে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা ও স্বচ্ছ নজরদারি বাড়াতে হবে। সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি দেশের ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোকেও বাজারে পণ্য আমদানি, বাজারজাতকরণ ও বিক্রির বিষয়ে খসড়া অনুমোদন করতে হবে। প্রত্যেক বাজারে সরকার কর্তৃক আধুনিক বিল-বোর্ডের মাধ্যমেও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেয়া যেতে পারে। এতে করে বাজারে গিয়ে ভোক্তারা জানতে পারবে আজকের বাজারদর এবং সে অনুযায়ী কেনাকাটাও করতে পারবে। তখন বাজারে সিন্ডিকেট কিংবা অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা বেশি দামে পণ্য বিক্রয়ের সম্ভাবনাও কমে আসবে।
এছাড়া ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন শক্তিশালী করে তার যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা দরকার। বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে বেশিরভাগ মানুষের আয় সীমিত এবং নির্দিষ্ট, সেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধির প্রভাব খুব গভীর। দাম বৃদ্ধির ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো সংসার চালাতেই হিমশিম খাচ্ছে। খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে হচ্ছে। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কেনাকাটা করতে হচ্ছে এবং প্রতিনিয়ত ব্যক্তিগত খরচ কাটছাঁট করতে হচ্ছে। এর ফলে মানসিক চাপ বেড়ে যাচ্ছে, দেখা দিচ্ছে পরিবারিক কলহ, বাড়ছে সামাজিক সমস্যা।
অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে মানুষ ঋণের দিকে ঝুঁকছে। যা পরবর্তী সময়ে এই স্বল্প আয়ের পরিবারগুলোতে আর্থিক সংকট আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। সংক্ষেপে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক সংকটেরও সূচনাবিন্দু। এর প্রতিকার করতে হলে সরকার, ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষ এবং দলমত নির্বিশেষে সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে।
সরকারকে তার নীতিমালা কঠোর করতে হবে এবং বাজারকে স্বচ্ছ ও নিয়ন্ত্রিত রাখতে হবে। ব্যবসায়ীদের উচিত স্বচ্ছতা বজায় রাখা এবং সিন্ডিকেট থেকে বিরত থাকা। আর আমাদের প্রত্যেক ভোক্তাকে সচেতন হতে হবে যাতে আমরা অবৈধ মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারি। শুধু তাত্ত্বিক আলোচনা নয়, বাস্তব পদক্ষেপেই টিকে থাকবে আমাদের দেশের অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের জীবন। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যেন জনজীবনে ভোগান্তির কারণ না হয় এই লক্ষ্যেই আমাদের সবাইকে একসাথে এগিয়ে যেতে হবে।