বাংলাদেশ থেকে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে জাপানে পাড়ি জমিয়েছিলেন মুন্সিগঞ্জের তরুণ আপন। মেধাবী এই যুবককে ঘিরে ছিল পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের বড় স্বপ্ন। কিন্তু সেই স্বপ্নই শেষ পর্যন্ত পরিণত হলো এক মর্মান্তিক ট্র্যাজেডিতে। চরম দারিদ্র্য, নিঃসঙ্গতা ও অবহেলার মধ্যে না-খেয়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
জানা গেছে, জাপানের সাইকামা শহরের কান্ত ইন্ডাস্ট্রিয়াল কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ছিলেন আপন। তিনি সেখানে অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করতেন। শুরুতে সব কিছু স্বাভাবিক থাকলেও গত বছরের শেষ দিকে তার জীবনে আসে অন্ধকার।
অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন আপন। টিউশন ফি দিতে না পারায় বন্ধ হয়ে যায় পড়াশোনা। একইসঙ্গে বাড়তে থাকে বাসাভাড়া ও অন্যান্য বিলের দেনা। একপর্যায়ে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ বন্ধ হয়ে যায় তার বাসায়। এমনকি মোবাইল চার্জ না করতে পারায় বন্ধ হয়ে পড়ে তার দুটি সিম কার্ডও। ফলে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
আপনের আর্থিক সংকট সম্পর্কে আত্মীয়-স্বজনরা জানলেও কেউ এগিয়ে আসেননি। তার সহপাঠী ও প্রতিবেশীরা জানান, মৃত্যুর অন্তত দুই সপ্তাহ আগে থেকে তাকে দেখা যায়নি। একদিন রান্নাঘরের জানালার ফাঁক দিয়ে তিনি বলেছিলেন, “কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।” তিনি জানিয়েছিলেন, চার দিন ধরে কিছু খাননি।
প্রতিবেশীরা খাবার দিয়ে গেলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি। জাপানের কঠোর ব্যক্তিগত গোপনীয়তার আইনের কারণে কেউ তার ঘরে ঢোকার সাহস পাননি। পরে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুলেন্স এসে দরজা ভেঙে ঘরে প্রবেশ করে। ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
২৬ বছর বয়সী আপনের নিথর দেহ পড়ে ছিল ঘরের ভেতর। তার এক চোখ খোলা ও আরেক চোখ আধা বন্ধ অবস্থায় ছিল। জাপান পুলিশের ময়নাতদন্তে জানা যায়, মৃত্যুর সময় তার ওজন ছিল মাত্র ১০ কেজির কিছু বেশি এবং তিনি দুই-তিন দিন আগেই মারা গেছেন।
আপনের এই মৃত্যু শুধু একজন তরুণের জীবনের অপমৃত্যুই নয়, এটি একটি পাষাণ সমাজের প্রতিচ্ছবি। প্রবাসে একজন শিক্ষার্থী চরম দারিদ্রে না-খেয়ে মারা গেল, অথচ কেউ পাশে দাঁড়াল না—এটাই কি আধুনিক সমাজব্যবস্থা? ন্যূনতম মানবিকতা দেখানো হলে, আজ হয়তো আপন হয়ে উঠতেন একজন সফল প্রকৌশলী, দেশের জন্য গর্বের একটি নাম।
এই মৃত্যু একক কারও নয়—এটি আমাদের সমাজের সম্মিলিত ব্যর্থতা। যেন আর কোনো তরুণ এইভাবে হারিয়ে না যায় ক্ষুধা, অবহেলা ও একাকিত্বের অন্ধকারে।