Ridge Bangla

স্ত্রীকে নিয়ে বিষেদগারের জবাবে যা বললেন আসিফ নজরুল

আসিফ নজরুল

সম্প্রতি এক কথিত লেখিকা বর্তমান আইন উপদেষ্টা ও লেখক আসিফ নজরুলের স্ত্রী শিলা আহমেদকে নিয়ে ফেসবুকে চরম বিষেদগার করেন।  বিরক্ত হয়ে ফেসবুকে উপদেষ্টা নজরুল ‘শীলার হিজাব’ নামে দীর্ঘ একটি লেখা লিখেছেন। তিনি যা লিখেছেন তা সরাসরি তুলে ধরা হলো।

শীলার সঙ্গে আমার বিয়ে হয় ২০১২ সালে। বিয়ের দুবছর পরে আমাদের কন্যা আরিনার জন্ম হয়। এর কিছুদিন পর থেকে ও হিজাব করা শুরু করে। আমাদের তখন একটাই প্রাইভেট গাড়ী ছিল (এখনো তাই)। সেটা প্রায় সারাদিন ব্যস্ত থাকতো আমাদের আগের সংসারের তিন সন্তানকে স্কুলে আনা-নেয়ার কাজে। শীলা ও আমাকে প্রায়ই সিএনজি বা রিকশায় চড়তে হতো। আমার সমস্যা হতো না তাতে। কিন্তু লম্বা ও ঘনচুল হিজাবে ঢাকা থাকার কারণে মাথা ভিজে শীলা অসুস্থ হয়ে যেতো। এটা নিয়ে আমার মন খারাপ থাকতো। কিন্তু শীলা নিজ সিদ্ধান্তে অনঢ় থাকে, কোন অবস্থাতেই হিজাব করা ছাড়েনি কখনো।

হিজাব শুরুর কিছুদিন পর একটা দাওয়াতে আমরা যাই। সেখানে আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও দেশের স্বনামধন্য একজন আইনজীবী আমার দিকে ভৎসনার চোখে তাকালেন। আমি বুঝলাম তিনি ভাবছেন শীলা বোধহয় আমার কারণেই হিজাব করতে বাধ্য হচ্ছে। এরপর সমাজের নামীদামী বহু মানুষ এভাবে আমার দিকে তাকিয়েছে। আমার একটু অদ্ভূত লাগতো। মানুষ কেন ভাবতে পারেনা যে একটা মেয়ে সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছেয় ইসলামী জীবন বেছে নিতে পারে, হিজাবও করতে পারে!

শীলা একসময় অভিনয় করতো। ১৯৯৫ সালে ১৪ বছর বয়েসে নিজের ইচ্ছেয় সে অভিনয় ছেড়ে দেয়। সেবছর অভিনয়ে জাতীয় পুরস্কার পেলে সেটা গ্রহন করতে পর্যন্ত যায়নি ও। এর বছর পাঁচেক পর ২০০০ সালে দাদার স্কুলের জন্য ফান্ড তৈরীর কথা বলে তার বাবা তাকে একটামাত্র নাটকে অভিনয়ে রাজী করাতে পারে। এরপর কোনদিন অভিনয়ের ধারেকাছে যায়নি সে বহু অনুরোধ পাওয়ার পরও।

কিন্তু মানুষ তার অভিনেত্রী পরিচয়টা আজো মনে রেখেছে। অভিনয় না করে সে অনেককিছু হারালো ভেবে সমবেদনায় উদ্বেল হয়েছে।

অথচ এনিয়ে তার বিন্দুমাত্র দু:খবোধ নেই। একসময় অভিনয় করতো এটা মনে করতেও চায় না। সে খুশি আছে তার নিজের জীবন নিয়ে। অর্থনীতিতে দুটো ফাষ্ট ক্লাশ ছিল তার। বড় বড় প্রতিষ্ঠানে অত্যন্ত সম্মানজনক পদে চাকরী করেছে, এখন কাজ করছে ‘ইকোনমিক এ্যন্ড কমার্শিয়াল স্পেশালিষ্ট’ হিসেবে সবচেয়ে প্রভাবশালী দূতাবাসে।

প্রখর মেধা, প্রবল আত্নমর্যাদাবোধ আর কঠোর ঔচিত্যবোধ সম্পন্ন এবং পেশাগত জীবনে অত্যন্ত সফল একজন মানুষ ও। অথচ এই সমাজের কিছু মানুষের কাছে শুধু ‘ আহা অভিনেত্রী’ আর ‘আহা হিজাব’ হয়ে রয়েছে আজো। কারো কারো কাছে এজন্য দায়ী মানুষটা আর কেউ না, আমি!

সত্য হচ্ছে, শীলাই বরং আমাকে ধর্মের পথে নিয়ে গেছে। এখনো ফজরের আজান হলে সে আমাকে ঘুম থেকে টেনে তুলে, ঠিকমতো যাকাত দিচ্ছি কিনা সেই হিসেব নেয়, দু’বছর আগে সেই আমাকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে হজ্জ করতে নিয়ে গেছে।

আমি জীবনে কোনদিন অসৎ উপার্জন করিনি আর মানুষের উপকার করার চেষ্টা করেছি সারাজীবন। এগুলো আমার জন্মগত। কিন্তু এছাড়া জীবনে যতো ভালো কিছু শিখেছি সব তার কাছে থেকে শেখা, যা কিছু ভালো করেছি সব তার অনুপ্রেরণায় করা।

আমার লাভ হয়েছে আরো অনেক। আমার মা ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক মানুষ। কখনো প্রচন্ড বিপদে পড়লে মা-কে বলতাম, আম্মা আমার জন্য দোয়া করেন। আমার ভয় কেটে যেতো, মনে হতো শেষ পর্যন্ত সব বিপদ কেটে যাবে আমার। শীলার সাথে বিয়ের কিছুদিন পর আম্মা মারা গেলেন। পরদিন কবরে গিয়ে অনেক কাঁদলাম। স্বার্থপরের মতো মনে হলো এখন আমার জন্য কে দোয়া করবে! কাকে বলবো দোয়া করতে।

আল্লাহ্ আমাকে সেই মানুষ দিয়েছেন। অপবাদ, মিথ্যাচার, হুমকি, ষড়যন্ত্র আমাকে যদি একটুও বিচলিত করে বা মর্মাহত, আমার স্ত্রী চুপচাপ কোরআন নিয়ে বসে, অনেকক্ষন বসে থাকে জায়নামাজে। শেষ পর্যন্ত কোন বিপদ থাকেনা আমার, থাকবেও না ইনশাল্লাহ্!

তসলিমা নাসরিন, আপনি গতকাল আমাদের নিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছেন। দোয়া করি, আপনার জীবনে হেদায়েত আসুক, কোন একদিন আল্লাহ্ ক্ষমা করুন আপনাকে। আপনি সেদিন বুঝবেন এই রেষারেষির জীবনের খ্যাতি, ধনমান, ক্ষমতা এসবের চেয়ে অনেক বিশাল আল্লাহ্-র দয়া। আমি সেটা এখনো পাইনি পুরোপুরি। কিন্তু আমার স্ত্রী পেয়েছেন। সে কতোটা ঐশ্বর্যবান, তার হৃদয়ে কতোটা প্রশান্তি -এটা আপনি কোনদিন ধারনা করতে পারবেন না।

তবু আপনি ভালো থাকুন।

আরো পড়ুন