আজ থেকে বছরপূর্বে জুলাইয়ের কথা। যখন ন্যায্য দাবি আর ইনসাফের প্রশ্নে আমরা ময়দানে দাঁড়িয়েছিলাম। বিপরীতে স্বৈরশাসক আমাদের উপর চালিছিলো গুলি। সে সময়টা ছিলো ভয়ঙ্কর এক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে জানপ্রাণ লড়াই-সংগ্রামের।
আজ বছর পেরুলেও সেই কঠিনতম দিনগুলোর স্মৃতি মস্তিষ্ক থেকে সরানো সম্ভব না। ১৬ জুন চট্টগ্রামে রক্তাক্ত দিন ছিলো। সেদিন চট্টগ্রামে প্রাণ দেয় ওয়াসিম, শান্ত, ফারুক। ১৭ তারিখ ঘর থেকে বেরুবার সুযোগ হয়নি। ১৮ জুলাই দিনটি ছিলো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বাঁচিয়ে রাখার দিন। সেদিন বৃষ্টির মতো বুলেট ছুঁড়ে প্রায় ১০ দিনের জন্য ইন্টানেট বন্ধ করে দেওয়া হয়।
ইন্টারনেট বন্ধের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আর লেখালেখির সুযোগ ছিলো না। তাই ডায়েরির পাতাই আমার স্মৃতি ধরে রাখবার একমাত্র মাধ্যম ছিলো। লড়াই-সংগ্রাম আর বাসায় অবস্থান সেসব তুলে ধরেছিলাম আমার ডায়রিতে।
১৯ জুলাই রাতে লিখেছিলাম, “আজ অনেক দিন পর লিখতে বসেছি। মনটা ভালো নেই। কক্ষে ঝিঁঝির ডাকে পরিবেশ পরিস্থিতি আগের মতোই। চাঁদটা বেশ আলো দিচ্ছে, দেখে বুঝবার উপায় নেই আজ ভয়ঙ্করতম দিন যাচ্ছে।”
সেদিন আরেক অংশে লিখেছিলাম, “১৯৭১ সালের যুদ্ধাবস্থা যেন তৈরি হয়েছে। তবে এবার রাজাকারের ভূমিকায় সেই আওয়ামী লীগ। তারা ক্ষমতার নেশায় বুঁদ হয়ে জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। সময়গুলো খুব কঠিন, ছাত্রদের ন্যায্য আন্দোলনে তারা পুলিশ দিয়ে হামলে পড়েছে। ঠিক যেন আইয়ুব খানের পুলিশ।”
১৯ জুলাই; চট্টগ্রামে আমাদের কর্মসূচি শুরু হবে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ থেকে। হবে গায়েবানা জানাযা ও বিক্ষোভ মিছিল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দূরত্ব ২৫ কিলোমিটারের বেশি হবে। নানা ছদ্মবেশে বের হয়ে আন্দরকিল্লা পৌঁছে যাই। কর্মসূচিতে যাবার আগে জানতাম না বেঁচে ফিরবো কিনা।
ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় টেবিলের ডায়রির পাতায় লিখে বের হয়েছি; যদি মারা পড়ি, আমার খোঁজ যেন পায় সবাই। ১৯ জুলাই ডায়েরির পাতা বলছে, “সারাদেশে ইন্টারনেট বন্ধ। গত পরশু ও গতকাল আমার ভাইয়েরা রক্ত দিয়েছে। আজ জুমার নামাযের পর আন্দোলনে যুক্ত হচ্ছি। আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ থেকে। বেঁচে ফিরলে আরো লিখবো, নয়তো ইতি। তবে বিপ্লব থামবে না। দুপুর ১২:২৫ মিনিট।”
কর্মসূচি সমাপ্ত করে বিপদশঙ্কুল ক্যাম্পাসে আবার ফিরে আসতে পেরেছিলাম। সেদিন কাজির দেউরি মোড়ে গুলি, টিয়ারশেল, সাউন্ডগ্রেনেড ছোড়া হয় আমাদের উপর। নানা কৌশলে সেই বিপদ সামলে এসেছিলাম।
তারপর ডায়েরির পাতা আরো এগিয়েছে। ২০ জুলাই রাত ১২টায় আবার বসেছি, সেদিন লেখা শুরু করেছিলাম এভাবে, “ঘড়ির কাঁটা ১২টা বাজার সাথে সাথে তারিখও পাল্টে গেলো। আজকের সন্ধ্যার আকাশটা খুব সুন্দর ছিলো। তবে সব ম্লান হয়ে গেছে দেশের পরিস্থিতির কাছে। গত দুদিন আগের আকাশটাও সুন্দর লাল আভা দিচ্ছিলো। তখন সেই আভা যেন ঢাবি আর জাবির রক্তের মতো, সেজন্য লাল আভা দিচ্ছে। দিনটি ছিলো পবিত্র আশুরা। ”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো খালি, অবস্থান শুধু ছাত্রলীগের। সব ক্যাম্পাস লীগমুক্ত হলেও চবি লীগমুক্ত করা যায়নি। মেসের অবস্থা বর্ণনা দিয়ে লিখেছিলাম, “মেসে আছি, সবাই চলে গেছে। আজ বউবাজারে গিয়ে দেখি একদম ফাঁকা। স্টুডেন্ট কেউ নাই। এই বিরুদ্ধ পরিবেশে খুব একা লাগছে নিজেকে। মেসে পুলিশের অভিযানের ভয়, তার উপর কারফিউ জারি হয়েছে। কাল থেকে নাকি আর্মি মাঠে নামবে। সেই পাকিস্তান আমলে খাজা নাজিমুদ্দিন কারফিউ ডাকতো। হাসিনা কি তার ভূমিকায়? আওয়ামী লীগকে জনগণ আর চায় না। ক্ষমতা, দম্ভ আর পাপের পথ মানুষকে কত নিচে নামায়!”
২১ জুলাই সারাদিন আবদ্ধ থাকার পর বেরিয়েছিলাম। দিনে বের হতাম না। কারণ কারো চোখে পড়লে রাজাকারদের হাতে মাইরের ভয়। আর ক্যাম্পাস ফাঁকা। ছাত্রলীগের ছেলেগুলো আমাকে ভালো করেই চিনতো।
সেদিন রাত ১২টা ৮ মিনিটে ডায়েরি নিয়ে আবার বসেছি, লিখেছি, “সারাদিন আবরুদ্ধ থাকার পর সন্ধ্যায় অস্থির হয়ে দু’কদম হাঁটতে বের হয়েছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে দক্ষিণ ক্যাম্পাসের পাহাড়িকা হাউজিং রোডের কালভার্টে বসে ছিলাম। কোনো পরিচিত মুখের দেখা নেই। সারাদেশের মতো এখানেও ইন্টারনেট বন্ধ। ঠিক কবে আসবে জানি না। সারাদেশের কোনো খবর পাচ্ছিলাম না। আমার কাছে রেডিও, টেলিভিশন নেই। পত্রিকাই একমাত্র ভরসা। তবে কতটুকু পরিস্থিতি উঠে আসছে তা নিয়ে সন্দিহান ছিলাম।”
মূলত, আমি তখন চট্টগ্রামে আটকা। ক্যাম্পাসের হল, মেস থেকে সবাইকে বের করে দিলেও আমি লুকিয়ে রয়ে গেছিলাম। ফ্যামিলি বাসার মধ্যে মেস হওয়ায় কেউ ঠিক ধরতে পারেনি আমাদের। আমরা দু-তিনজন ছিলাম। আমিই একমাত্র শহরে যেতাম আন্দোলনে। কখনো হাতে কাঁচাবাজার নিয়ে ভান ধরে রাস্তা পেরিয়ে আসতাম। নানা কৌশল করে চলাচলা করতে হয়েছিলো।
পরদিন শহরে যাবো ভেবেছি, সেসব নিয়ে ডায়রির পাতায় লিখেছি, “কাল আবার শহরে যাবো। বেলা ১২টার দিকে। সকাল ১০টায় কারফিউ শেষ হবে। আবার কোটার রায়ও হবে। কোটা যদি ৫% ও রাখে সব দাবি মেনে নেয় তবুও কি লাশের দাম মিলবে? কবি শামসুর রাহমানের ভাষায়,
এ লাশ আমরা রাখব কোথায়? তেমন যোগ্য সমাধি কই?
মৃত্তিকা বলো, পর্বত বলো অথবা সুনীল-সাগর-জল—সবকিছু ছেঁদো তুচ্ছ শুধুই!”
ইন্টারনেট না থাকায় মোবাইলের সিমকার্ডে এসএমএস কিনতাম ৩০০/৪০০ করে। এসব এসএমএস লিখে একেকজনের সাথে যোগাযোগ রাখতাম। ২২ জুলাই সোমবার রাত ২টায় আবার লিখতে বসেছিলাম, “টোস্ট বিস্কুটে নাস্তা সেরে জানতে পারতাম কারফিউয়ের মেয়াদ বেড়েছে। কী করবো, আমার বায়েজিদ যাওয়ার কথা ছিলো।”
সেদিন বেড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের অবস্থানের কথা লিখেছিলাম, “সব ছাত্রকে হল থেকে বের করে দিয়ে ছাত্রলীগকে হলে রেখে দিছে। তারা বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের রাজাকার বলা চলে। রাজাকাররা ক্ষমতাশালী আর আমরা যারা বৈষম্যবিরোধী তারা এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছি।”
দিন যত গিয়েছে, আমার ডায়েরির পাতা এগিয়েছে। ৬ আগস্ট পর্যন্ত নানা ঘটনা লিপিবদ্ধের চেষ্টা করেছি। ইন্টারনেট বন্ধের সময়গুলো দুশ্চিন্তা ভয় ছিলো মনে। রুমে বড় বড় লাঠি রেখেছিলাম, কেউ যদি আক্রমণ করতে আসে যেন প্রতিহত করতে পারি। তার বাইরে বইয়ের পাতায় চোখ বোলানো, ডাউনলোড করে রাখা রাজনৈতিক লেকচার, এসব দেখে-পড়ে সময় কেটেছি।
কখনো টলমল চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেছি। শান্ত পাহাড়ঘেষা এ জোবরা গ্রামে থেকে বাংলাদেশের ভয়াল পরিস্থিতি আন্দাজ করতে পেরেছিলাম। এই শান্ত গ্রামেও আওয়ামী হানাদারের উপস্থিতি ছিলো। কখনো আন্দোলনে যুক্ত হওয়া, জন্মস্থান গাজীপুরের খোঁজ নেয়া, যে যেখানে আন্দোলনে আছে ভিন্ন ভিন্ন জেলায় তাদের সেখানকার খবর জেনেছি। বিশেষ করে ঢাকার খবর পাওয়ার চেষ্টা বেশি করতাম। ঢাকার বিভিন্ন জোনে আমার পরিচিত মানুষদের ফোন করতাম।
একটা বদ্ধ, বিরুদ্ধ পরিবেশ গিয়েছে আমাদের উপর। হাজার হাজার শব্দে সেসব ঘটনা, অনুভূতি বর্ণন করা সম্ভব নয়। জুলাই একটা তীব্র আবেগ, অনুভূতির নাম; তীব্র শক্তির নাম। আমার সারা জীবনের দুঃসহ স্মৃতি হয়ে রবে সময়গুলো। ডায়েরির পাতায় লেখা ছিলো, “অত্যাচারী আর অত্যাচারের মাত্রা যত বেশি বাড়বে, মুক্তি তত দ্রুত ধেয়ে আসবে।” আজ মুক্তি মিলেছে, কিন্তু সেইসব দিনরাত্রি ভুলবার নয়।