দীর্ঘ ১৭ বছর পর প্রথমবারের মতো কোনো গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। যুক্তরাজ্যের লন্ডনে নির্বাসিত জীবনযাপন করা এই নেতার সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বিবিসি বাংলার সম্পাদক মীর সাব্বির ও সিনিয়র সাংবাদিক কাদির কল্লোল।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন এবং জনগণের আলোচিত নানা প্রশ্নেরই উত্তর তিনি দিয়েছেন, যেখানে দেশে ফেরার সম্ভাবনা, নির্বাচন এবং দলের কৌশলসহ সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সব বক্তব্য উঠে এসেছে।
৪৪ মিনিট ৩৪ সেকেন্ডের সেই সাক্ষাৎকারটি প্রকৃতপক্ষে বিবিসি বাংলার সাথে তারেক রহমানের সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব। চমকপ্রদ ব্যাপার হলো- সাক্ষাৎকারে তারেক রহমান কয়েকটি শব্দ একাধিকবার উচ্চারণ করেছেন! যার মধ্যে “জনগণ” শব্দটি উচ্চারণ করেছেন প্রায় ২৫ বার, “বাংলাদেশ” শব্দটি ১৮ বার এবং “গণতন্ত্র” শব্দটি ১২ বার!
এই লেখায় তারেক রহমানের সাক্ষাৎকারের ১ম পর্বের চুম্বক অংশগুলোই তুলে ধরা হয়েছে।
কোনো গণমাধ্যমে দীর্ঘ সময় কথা না বলার কারণ
তারেক রহমান বলেছেন, ‘আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, বিগত স্বৈরাচারী সরকারের সময় আদালত থেকে রীতিমতো একটা আদেশ দিয়ে আমার কথা বলার অধিকারকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আমি যদি গণমাধ্যমে কিছু বলতে চাইতাম, হয়তো গণমাধ্যমের ইচ্ছা ছিল ছাপানোর, গণমাধ্যম সেটি ছাপাতে পারত না।’
তবে তিনি এটাও জানিয়েছেন যে, তিনি কখনোই নিজেকে সম্পূর্ণভাবে গণমাধ্যম থেকে বিচ্ছিন্ন করেননি। তবে বিগত স্বৈরাচারী সরকারের সময় আদালত তার গণমাধ্যমে কথা বলার অধিকার সীমিত করেছিল। তিনি বলেন, “প্রেসক্লাবে একবার কথা বলেছিলাম। কিন্তু পরের দিন তখনকার প্রেসক্লাবের সদস্যরা মিটিং করে আমাকে বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত রাখে। আমি থেমে থাকিনি। সামাজিক মাধ্যম এবং বিভিন্ন মাধ্যমে আমি জনগণের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছি।”
দেশে ফেরার পরিকল্পনা
দেশে ফেরার প্রশ্নে তারেক রহমান জানিয়েছেন, “কিছু সংগত কারণে হয়তো এখনো ফেরাটা সম্ভব হয়নি। তবে সময় এসেছে। ইনশাআল্লাহ দ্রুতই ফিরে আসবো।”
নির্বাচনের আগে দেশে আসার সম্ভাবনা জানতে চাইলে তিনি নিশ্চিত করেন, “যেখানে জনগণ প্রত্যাশিত নির্বাচন চাইছে, সেখানে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব এবং জনগণের সাথে থাকব।” সেই সাথে তিনি যোগ করেন, নিরাপত্তার শঙ্কা থাকলেও তিনি সেই শঙ্কা জনগণের প্রত্যাশিত নির্বাচন এবং রাজনৈতিক কার্যক্রমের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সামলাচ্ছেন।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ভূমিকা
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিজের ভূমিকা সম্পর্কে তারেক রহমান খোলাখুলিই বলেছেন, নিজেকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাস্টারমাইন্ড মনে করেন না তিনি। তার ভাষ্যমতে, “এ আন্দোলন সফল হয়েছে, কিন্তু এটি বহু বছর ধরে প্রস্তুত। এখানে বিএনপি, অন্যান্য গণতান্ত্রিক দল, সাধারণ মানুষ, ছাত্র, শ্রমিক, গৃহিণী সবাই অংশগ্রহণ করেছে। এই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড কেউ নয়, বরং বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ।”
নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং বিএনপির কৌশল
অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা, নির্বাচন ও রাজনৈতিক জোট নিয়ে তারেক রহমানের বক্তব্য, বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চায় এবং এটি দেশের স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার মতে, “যত দ্রুত নির্বাচন হবে, জনগণের রাজনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। নির্বাচন মাধ্যমে দেশের মালিক জনগণ তাদের পছন্দমতো সিদ্ধান্ত নেবে। এটি ধাপে ধাপে দেশের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনবে।”
তারেক রহমান নির্বাচনে সরাসরি অংশগ্রহণের ইঙ্গিত দিয়েছেন, “নির্বাচনের সময় আমি অবশ্যই জনগণের মাঝে থাকব। দলের সদস্য হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করব। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব ইনশাআল্লাহ।” তবে প্রধানমন্ত্রী পদে তাঁর প্রত্যাশা সম্পূর্ণভাবে জনগণের ওপর নির্ভর করছে।
নমিনেশন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে তিনি বলেন, বিএনপি প্রার্থীদের নির্বাচনের জন্য শুধুমাত্র দলীয় সমর্থনের ভিত্তিতে নয়, বরং জনগণের সমর্থন ও এলাকার সমস্যার সমাধান করার দক্ষতার ভিত্তিতে বাছাই করবে। তিনি বলেন, “যে প্রার্থী বিভিন্ন শ্রেণি, পেশার মানুষের সাথে যোগাযোগ রাখে এবং জনসমর্থন পায়, তাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে।”
খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য ও নির্বাচনে ভূমিকা
সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের ব্যাপারে তারেক রহমান গভীর শংকা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “আপনি এমন একজন মানুষের কথা বলেছেন, যেই মানুষটি বাংলাদেশের গণতন্ত্র, যতবার গণতান্ত্রিক অধিকারকে হরণ করা হয়েছে, প্রতিবার উনি অবদান রেখেছেন। সেই গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত বা পুনরুদ্ধার করার জন্য। আপনাদের সকলের চোখের সামনেই ঘটেছে যে কীভাবে স্বৈরাচারের সময় তার উপরে অত্যাচারের খড়গহস্ত নেমে আসে। কিন্তু উনি আপোষ করেননি।”
“এরকম একজন ব্যক্তি আজ অসুস্থ। কেন কীভাবে উনি শারীরিকভাবে অসুস্থ হলেন, মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে তাকে জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হলো। আমরা দেখেছিলাম একজন সুস্থ মানুষ গিয়েছেন। কিন্তু যখন বেরিয়ে এসেছেন একজন অসুস্থ মানুষ বেরিয়ে এসেছেন। তাকে চিকিৎসার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছে। এ সবগুলোই ঘটনা দেশবাসী জানেন। তারপরেও যে মানুষটির এত বড় অবদান রয়েছে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করার। আমি সেই দলের একজন কর্মী হিসেবে বিশ্বাস করি বা বিশ্বাস করতে চাই- গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে যেই প্রত্যাশিত, জনপ্রত্যাশিত যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, উনার শারীরিক সক্ষমতা যদি অ্যালাউ করে উনাকে, নিশ্চয়ই উনি কিছু না কিছু ভূমিকা রাখবেন।”
বিএনপির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব
তারেক রহমান স্পষ্ট করেছেন, বিএনপির নেতৃত্ব পরিবারকেন্দ্রিক নয়, বরং সমর্থন ও দক্ষতার ভিত্তিতে দলের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নির্বাচিত হবে। “রাজনীতিতে পরিবারকরণ হয় না। যারা জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং দলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, তারাই নেতৃত্বে আসবেন। সময় এবং পরিস্থিতি এটি প্রমাণ করবে।”
বিএনপি দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দখল-চাঁদাবাজির অভিযোগ
বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি বা দখলের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, বিভিন্ন অভিযোগের প্রেক্ষিতে পার্থক্য করা হচ্ছে এবং প্রমাণিত অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে সরকারের কাছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব অর্পিত। “দলের কাজ পুলিশিং করা নয়। যারা দোষী তাদের বিচারের দায়িত্ব সরকারের,” বলেন তিনি।
জাতীয় রাজনীতিতে ডাকসু নির্বাচনের প্রভাব
ডাকসুর নির্বাচনের ফলাফলের প্রেক্ষিতে তারেক রহমান বলেন, “ছাত্ররাজনীতি ছাত্ররাজনীতির জায়গায়। জাতীয় রাজনীতি আলাদা। এটি জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে না।”
জামায়াতে ইসলামী ও বহুদলীয় রাজনীতি
জামায়াতে ইসলামী এবং বহুদলীয় রাজনীতি প্রসঙ্গে তারেক বলেন, “যারা সংবিধান ও আইন মান্য করে রাজনীতি করে, তাদের রাজনীতি করার অধিকার রয়েছে। বিএনপি সবসময় বহুদলীয় রাজনীতিতে বিশ্বাস করে।”
আওয়ামী লীগের বিচার ও অপশাসনের প্রভাব
জুলাই গণঅভ্যুত্থান এবং স্বৈরাচারের সময় আওয়ামী লীগের ভূমিকা নিয়ে তিনি বলেন, “যে দল বা ব্যক্তি অন্যায় করেছে, তার বিচার আইন অনুসারে হবে। জনগণ সমর্থন না করলে সেই দল দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে পারবে না।”
“আমি ১৭ বছর যাবত প্রবাস জীবনে আছি। ওয়ান ইলেভেন, তথাকথিত ওয়ান ইলেভেন সরকারের সময় যেই শারীরিক নির্যাতন আমার উপরে হয়েছিল, তারপরে চিকিৎসার জন্য আমি এই দেশে আসি। আমি যখন এখানে আসি, আমার ভাইকে আমি রেখে এসেছিলাম, ছোট ভাইকে। আমি যখন এই দেশে আসি আমার সুস্থ মাকে আমি রেখে এসেছিলাম। একটি ঘর রেখে এসেছিলাম। যেই ঘরে আমি এবং আমার ছোট ভাই বড় হয়েছি। যেই ঘরে আমার বাবার স্মৃতি ছিল। যেই ঘরে আমাদের দুই ভাইয়ের সন্তানরা জন্মগ্রহণ করেছিল। যেই ঘরে আমার মায়ের বহু স্মৃতি ছিল। সেই স্মৃতিগুলোকে ভেঙে চুড়ে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে ভাইকে আমি রেখে এসেছিলাম সেই ভাই এখন আর নেই। যেই সুস্থ মাকে রেখে এসেছিলাম, সেই সুস্থ মা এখন সুস্থ নেই। শুধু অসুস্থই নন, উনার উপরে মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতনও করা হয়েছে।
দেশের উন্নয়ন ও ভোটারদের আশ্বস্তকরণ
দেশের উন্নয়ন, দুর্নীতি ও জনগণের জীবনমান উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তারেক রহমান। ২০০১–২০০৬ সালের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বলেন, “সমস্যাগুলো ধাপে ধাপে সমাধান করা হবে। জনগণ যদি আমাদের সুযোগ দেয়, আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব দেশের সম্মান এবং মানুষের জন্য উন্নয়ন নিশ্চিত করতে।”
রাজনৈতিক পরিবেশ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
তারেক রহমান উল্লেখ করেছেন, বিএনপি সামনের দিনে জনগণের কল্যাণ, স্বচ্ছতা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার দিকে মনোযোগ দেবে। ১৭ বছর পর এই বিস্তৃত সাক্ষাৎকারে তারেক রহমান স্পষ্ট করেছেন, তিনি দেশে ফিরবেন, নির্বাচনে অংশ নেবেন, দলের কৌশল জনমুখী হবে এবং বিএনপি পরিবারকেন্দ্রিক নয়, জনগণমুখী নেতৃত্বের ওপর নির্ভর করবে।
“আমরা বিশ্বাস করি এবং বিভিন্ন সময় বলিও- আমরা বিএনপি যারা করি, আমাদের রাজনৈতিক সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এবং বিশ্বাস করতে চাই- যে দলের ব্যক্তিরা বা যে দল মানুষ হত্যা করে, মানুষ গুম করে, মানুষ খুন করে, দেশের মানুষের অর্থসম্পদ লুটপাট করে বিদেশে পাচার করে- জনগণ তাদেরকে সমর্থন করতে পারে বলে আমি মনে করি না।
জনগণ যদি সমর্থন না করে কোনো রাজনৈতিক দল বা রাজনৈতিক সংগঠনকে, তাদের টিকে থাকার তো কোনো কারণ আমি দেখি না। যেহেতু জনগণের শক্তিতে আমরা বিশ্বাস করি, জনগণের সিদ্ধান্তে আমরা বিশ্বাস করি। জনগণের সিদ্ধান্তের উপরে আমরা আস্থা রাখতে চাই। এ বিষয়ে সবচেয়ে বড় বিচারক আমি মনে করি জনগণ।”