বাংলাদেশের চাল বাজারে বহুল প্রচলিত ‘মিনিকেট’ নামে কোনো ধানের জাত দেশে নেই বলে নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউশন (ব্রি)। এই চাল আসলে বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ জাতের ধান থেকে আধুনিক প্রক্রিয়ায় পালিশ, ছাঁটাই ও প্যাকেজিংয়ের মাধ্যমে তৈরি করা হয়। এতে ক্রেতাদের বিভ্রান্ত করে একপ্রকার প্রতারণামূলক ব্যবসা চলছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ব্রি’র পক্ষ থেকে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ‘মিনিকেট’ নামে কোনো ধানের জাত কখনো বাংলাদেশে চাষ হয়নি। এটি মূলত একটি বিপণন কৌশল, যার মাধ্যমে বাজারে ‘বিশেষ’ চাল হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। মিল মালিকরা বিআর-২৮ বা বিআর-২৯ ধান থেকে প্রাকৃতিক আবরণ সরিয়ে একাধিকবার পালিশ করে চালকে চকচকে ও সাদা করে তুলেন। এরপর আকারে ছোট করতে ছাঁটাই করা হয় এবং শেষে ‘মিনিকেট’ নামে বিক্রি করা হয়।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা জানান, অতিরিক্ত পালিশের ফলে চাল থেকে ভিটামিন বি১, বি৬, আয়রন এবং আঁশসহ গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান নষ্ট হয়ে যায়। ফলে মিনিকেট চাল নিয়মিত খাওয়ার ফলে শরীরে শর্করার মাত্রা বাড়তে পারে, যা ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য রোগের ঝুঁকি সৃষ্টি করে।
সরকার ২০২৩ সালের ১১ জুলাই চালের প্রকৃত জাতের নাম ছাড়া অন্য নামে বাজারজাত নিষিদ্ধ করে একটি আইন পাস করে। এতে বলা হয়, আইন ভঙ্গ করলে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা হতে পারে। তারপরও বাজারে ‘মিনিকেট’ নামে চালের বিক্রি বন্ধ হয়নি।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এই বিষয়ে চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছে। সংস্থার উপপরিচালক আতিয়া সুলতানা জানান, তারা ব্যবসায়ীদের নিষিদ্ধ নাম ব্যবহার না করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং ব্যবসায়ীরা সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। তবে পণ্যের ব্যাপক প্রচলন থাকায় তা একদিনে বন্ধ করা সম্ভব নয় বলেও জানান তিনি।
ঢাকার পাইকারি ও খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ‘তীর’, ‘সাগর’, ‘রশিদ’, ‘মোজাম্মেল’সহ নানা ব্র্যান্ড এখনও মিনিকেট নামে চাল বিক্রি করছে। এসব চালের দাম প্রতি কেজি ৮০–৮৫ টাকা পর্যন্ত, যেখানে বিআর-২৮ চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৫–৬০ টাকায়।
বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ কে এম খোরশেদ আলম বলেন, মিনিকেট নামে বাংলাদেশে কোনো ধান নেই, এটি ভারতের একটি চাল জাত। তবে ভোক্তাদের চাহিদা ও লাভের হিসাবেই মিল মালিকরা এভাবে প্রক্রিয়াজাত চাল বাজারজাত করছেন।
ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান জানান, ব্যবসায়ীদের ১৫ দিনের মধ্যে বাজার থেকে মিনিকেট নামের চাল সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে। তবে হঠাৎ সরিয়ে নিলে চাল সংকট তৈরি হতে পারে বলেও মত দিয়েছেন তিনি। প্রয়োজনে আইন কিছুদিনের জন্য শিথিল করার কথাও ভাবা হচ্ছে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) পক্ষ থেকে একে প্রতারণা বলে অভিহিত করা হয়েছে। ক্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, সরকারকে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। চালের প্রকৃত জাতের নামে বিক্রি নিশ্চিত করতে না পারলে ভোক্তা যেমন ঠকবে, তেমনি স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়বে।
সবশেষে, মিনিকেট নামে চাল বিক্রি একদিকে যেমন আইনবিরোধী, তেমনি ভোক্তা প্রতারণার স্পষ্ট উদাহরণ। খাদ্যে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন তথ্যপ্রকাশ ও কঠোর আইন প্রয়োগ।