উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের মর্মান্তিক ঘটনায় ফের একবার নগরকেন্দ্রিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সোমবার (২১ জুলাই) দুপুরে ঘটনার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় ও ঘটনাস্থলে এখন পর্যন্ত ৩২ জন প্রাণ হারিয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই শিশু।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, জরুরি সেবা ব্যবস্থার উন্নত অবকাঠামো থাকলে এত প্রাণহানি এড়ানো সম্ভব হতো। বর্তমানে রাজধানীতে চারটি সরকারি মেডিকেল কলেজ ও দুটি জেনারেল হাসপাতাল থাকলেও কেবল শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রয়েছে ‘ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি অ্যান্ড ক্যাজুয়ালিটি সার্ভিস’ (ওএসইসি)। বাকি হাসপাতালগুলোতে এমন সেবা না থাকায় জরুরি চিকিৎসায় বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দেয়।
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল দুর্ঘটনাস্থলের কাছে হলেও তারা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অপ্রস্তুত ছিল। আহতদের পরিবহনে অ্যাম্বুলেন্সও পাঠানো হয়নি। অথচ দগ্ধ রোগীদের দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া গেলে তাদের বাঁচার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যেত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দগ্ধদের মৃত্যু অনেক সময় পানিশূন্যতা বা কিডনি বিকলের কারণে ঘটে। কিন্তু হাসপাতালগুলোর জরুরি সেবা দেওয়ার প্রস্তুতি বা প্রশিক্ষিত জনবল না থাকায় এই বিপর্যয়ে কার্যকর সাড়া দেওয়া যায়নি। ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, “দেশে এখনো জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা পূর্ণাঙ্গভাবে গড়ে ওঠেনি।”
একটি কার্যকর ওএসইসি ইউনিটে ২৯ শয্যার লাইফ সাপোর্টযুক্ত ইউনিট, জরুরি পরীক্ষা ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি থাকার কথা। বর্তমানে কেবল সোহরাওয়ার্দীতেই এমন ব্যবস্থা আছে, যা সামগ্রিকভাবে অপ্রতুল। একইসঙ্গে জরুরি রোগীদের দ্রুত হাসপাতালে স্থানান্তরের জন্য নির্ভরযোগ্য অ্যাম্বুলেন্স নেটওয়ার্কের অভাবও রয়েছে।
মাইলস্টোন দুর্ঘটনায় দেখা গেছে, আহত শিশুদের হাসপাতালে নিতে অভিভাবকরা ভয়ানক সংকটে পড়েছেন। বার্ন, প্লাস্টিক, কিডনি ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞদের সমন্বিত পুল না থাকায় চিকিৎসা ব্যবস্থায় ঘাটতি দেখা দেয়। আগে বার্ন ইনস্টিটিউটে এমন পুল থাকলেও এখন তা বিলুপ্ত।
স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. জাকির হোসেন বলেন, “হাসপাতালগুলোতে কার্যকর ‘ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট ইউনিট’ নেই। ‘ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার’ নারীর সহিংসতা রোধে ব্যবহৃত হয়, দুর্ঘটনায় নয়।”
এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিবন্ধিত চিকিৎসক রাখার বিধান থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয় না। মাইলস্টোনে যদি চিকিৎসক থাকতেন, প্রাথমিক চিকিৎসা তাৎক্ষণিকভাবে দেওয়া যেত।
এই ট্র্যাজেডি ফের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে জরুরি সেবা এবং দুর্যোগ প্রস্তুতির ক্ষেত্রে কতটা ঘাটতি রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই সময় সমন্বিত, প্রশিক্ষিত এবং প্রস্তুত একটি জরুরি স্বাস্থ্যসেবা কাঠামো গড়ে তোলার।