বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০২৪ সালের জুলাই মাস এক গভীর রাজনৈতিক পালাবদলের সময় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ২৬ জুলাই ইতিহাসের এক টালমাটাল দিনে কারফিউ শিথিল, গণগ্রেফতার ও উদ্বেগ নিয়ে গভীর সংকটে মধ্য দিয়ে কেটে যায়। এই সময়েই কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে দেশজুড়ে শুরু হয় এক নজিরবিহীন গণআন্দোলন, দমন-পীড়ন ও সহিংসতার পর্ব। ২৬ জুলাই, দিনটির গুরুত্ব এ কারণে আরও বেড়ে যায় যে, এই দিনে টানা কয়েকদিনের কারফিউ কিছুটা শিথিল করা হয় এবং আন্দোলনের পটভূমিতে ঘটে যায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনা।
২০২৪ সালের ২৬ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনের তিন শীর্ষ সমন্বয়ক—নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ও আবু বাকের মজুমদার—কে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে যায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এরই মধ্যে ১৭ থেকে ২৬ জুলাই পর্যন্ত সারা দেশে মোট ৬ হাজার ২৬৪ জনকে গণগ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত গ্রেফতার হয় ৭৬৫ জন। রাজধানীতে এদিন ২০৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকায় মোট মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ২০৯টি। এছাড়া এই দিন ঢাকার বাইরে নতুন ২২টি ও ঢাকায় ৮টি মামলা রুজু হয়।
২৬ জুলাইয়ের সকালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ঘোষণা দেন, ঢাকা, গাজীপুর, নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জে শুক্র ও শনিবার সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল থাকবে। চলমান সহিংসতার মধ্যে সাধারণ মানুষের চলাচলের সুবিধার্থে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে রাজধানীজুড়ে সেনা টহল ও নিরাপত্তা বাহিনীর অবস্থান ছিল কঠোর।
এই দিন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে জানায়, বাংলাদেশে চলমান আন্দোলনে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেছে। সংস্থাটি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এসব পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘনের শামিল।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা সরকারের ঘোষিত কোটা সংস্কার প্রজ্ঞাপনকে সমাধান হিসেবে মেনে নেয়নি। তারা জানায়, এতে কোনো স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আলোচনা হয়নি এবং প্রজ্ঞাপনের ভাষা ও কাঠামো পরিষ্কার নয়। আন্দোলনের দাবিতে তারা রাষ্ট্রীয় সহিংসতা, হত্যা-গুমের বিচার, গ্রেফতার ও মামলা প্রত্যাহারসহ আরও কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করেছে।
২৬ জুলাইয়ের আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক ছিল সারাদেশে শুরু হওয়া ‘ব্লক রেইড’। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, এদিন পর্যন্ত কোটা সংস্কার ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ঘিরে মোট ৫৫৫টি মামলা হয়েছে এবং ৬ হাজার ২৬৪ জন গ্রেফতার হয়েছেন।
২০২৪ সালের জুলাই শুধু একটি মাস নয়, বরং স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি চূড়ান্ত মোড় পরিবর্তনের সময়। সেই পালাবদলের গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায় রচিত হয়েছিল এই ২৬ জুলাই তারিখে।