বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের মধ্যকার প্রাকৃতিক সীমানা নাফ নদ এখন জীবিকার চেয়ে বেশি ভয় ও শোকের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মিয়ানমারের বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান আর্মির হাতে শতাধিক বাংলাদেশি জেলে আটক হয়েছেন। কেউ ফিরে এসেছেন নির্যাতনের ক্ষত নিয়ে, আবার অনেকেই এখনো নিখোঁজ।
টেকনাফ উপজেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে অন্তত ১১৬ জন জেলে এবং ১৩টি ট্রলার মিয়ানমারভিত্তিক ওই গোষ্ঠীর হাতে পড়েছে। অন্যদিকে বিজিবির তথ্য বলছে, চলতি বছরের নয় মাসে ২৩৫ জন জেলেকে আটক করেছে আরাকান আর্মি; তাদের মধ্যে ১২৪ জন ফিরে এলেও ১১১ জন এখনো বন্দি, যাদের মধ্যে ৬২ জন রোহিঙ্গা জেলে।
আরাকানে জান্তা সরকারের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে পড়ার পর থেকেই ওই অঞ্চলে আরাকান আর্মির প্রভাব বাড়ছে। ফলে সীমান্তের নদীপথ এখন কার্যত তাদের নিয়ন্ত্রণে। স্থানীয় প্রশাসনের দাবি, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে কোনো বৈধ সরকার না থাকায় আন্তঃরাষ্ট্রীয় যোগাযোগের সুযোগ নেই, তাই বাংলাদেশ একতরফাভাবে উদ্ধার অভিযান চালাতে পারছে না।
ফেরত আসা কয়েকজন জেলের ভাষ্যমতে, তাদের হাত-পা বেঁধে মারধর করা হয়, পর্যাপ্ত খাবারও দেওয়া হয়নি। অনেককে বাধ্য করা হয় কৃষিকাজে, কেউ কেউ পালিয়ে প্রাণে বেঁচেছেন। আটক জেলেদের কাছ থেকে বাংলাদেশের সীমান্তচৌকির অবস্থান জানতে চাওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
একই পরিবারের একাধিক সদস্য হারিয়ে বহু পরিবার দিশেহারা। সেন্টমার্টিনের মদিনা বেগম বলেন, চার সন্তানকে হারিয়ে খেয়ে-না-খেয়ে দিন কাটছে। শুধু চাই ওরা যেন ফিরে আসে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শাহপরীর দ্বীপ, সেন্টমার্টিন ও টেকনাফের অন্তত শতাধিক পরিবারে এখন নেমে এসেছে কান্না ও অনিশ্চয়তা।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (ICG) আরাকান আর্মির এই অপহরণের তিনটি কারণ উল্লেখ করেছে। প্রথমত, জান্তা সরকারের হামলার আশঙ্কায় আরাকান আর্মির নদীপথে টহল জোরদার করেছে, ফলে বাংলাদেশি জেলেরা তাদের টার্গেটে পড়ছেন। দ্বিতীয়ত, খাদ্য ও পণ্যের ঘাটতির কারণে জেলেদের বোট, মাছ ও সরঞ্জাম লুট করছে গোষ্ঠীটি। তৃতীয়ত, এসব অপহরণ ও জেলেদের আটকের মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছে গোষ্ঠীটি; এর মাধ্যমে নিজেদের রাজনৈতিক স্বীকৃতি আদায়ের প্রচেষ্টাও রয়েছে বলে জানা গেছে।
জেলেরা বলছেন, নাফ নদে সীমানা স্পষ্টভাবে নির্ধারিত নয়। ফলে অনেকে অনিচ্ছাকৃতভাবে মিয়ানমার অংশে ঢুকে পড়েন। জোয়ারের সময় দিকভ্রান্ত হয়ে মিয়ানমারের ভেতরে চলে যাওয়া বা অনেক সময় ইচ্ছে করেই বেশি মাছের আশায় সীমানা অতিক্রমের ঘটনাও ঘটে।
টেকনাফের ইউএনও শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, মিয়ানমার সীমান্তে গেলে জেলেদের আটক করছে আরাকান আর্মি। আমরা জেলেদের সতর্ক করছি, কিন্তু বিদেশি জলসীমায় গিয়ে সরাসরি ব্যবস্থা নেওয়াও প্রশাসনের পক্ষে সম্ভব নয়।
জানা গেছে, আকার অনুযায়ী বোট পরিচালনায় একটি ট্রিপে অন্তত ২০ লাখ থেকে দেড় কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যয় হয়। বোট ও জেলে হারিয়ে যাওয়ায় এবং অপহরণের হুমকি ক্রমাগত বাড়তে থাকায় স্থানীয় অর্থনীতি ও মাছ ধরার শিল্পও হুমকির মুখে। বোট মালিকরা বলছেন, যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে তারা মাছ ধারা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবেন।