সারা দেশে প্রতিনিয়ত হত্যাসহ বিভিন্ন গুরুতর অপরাধের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। এক একটি হত্যার ঘটনা যেন খুনের নতুন নতুন চিত্র নিয়ে হাজির হচ্ছে আমাদের সামনে। ক্রমাগত বাড়তে থাকা এসব হত্যা, নৃশংসতা নিয়ে প্রায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে সমাজ চিন্তাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা।
সম্প্রতি গত ৩ ডিসেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে মইদুল সর্দার (৪০) নামে এক যুবককে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। রংপুরের ব্যবসায়ী আশরাফুলকে ঢাকায় ডেকে নিয়ে খুন করে বন্ধু জারেজ মিয়া ও তার বান্ধবী। পরে লাশ ২৬ টুকরো করে ড্রামে ফেলে যায়। চাঁদপুরে পারিবারিক বিরোধে এক ছেলে দা দিয়ে প্রকাশ্যে বাবার মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। খুলনায় দুই যুবককে আদালত গেটের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়। এদিকে ঢাকার মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পেও প্রায়শই বোমাবাজি ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এসব হত্যা ও সহিংসতার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ খুনির মাদকাসক্তি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য মতে, দেশব্যাপী প্রতিদিন গড়ে ১০-১২টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। বেসরকারি সংস্থাগুলোর দাবি, প্রকৃত খুনের সংখ্যা আরও বেশি এবং তা ক্রমেই বেড়ে চলেছে, যার পেছনে বড় কারণ মাদক।
দেশজুড়ে এখন এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে মাদক পাওয়া যায় না। শহরের পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও মাদক হয়ে উঠেছে সহজলভ্য। বিভিন্ন এলাকায় মোটরসাইকেলযোগে প্রকাশ্যে ইয়াবা সরবরাহ হচ্ছে। এসব কাজে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তরুণ ও উঠতি বয়সের যুবকদের জড়িত হতে দেখা যাচ্ছে।
এই ধরনের মাদক কারবারে রাজনীতিবিদদের একটি অংশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যও জড়িত আছে বলে অভিযোগ মিলছে। সমুদ্র পথ, আকাশ পথ কিংবা স্থল পথে নানাভাবে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে মাদক প্রবেশ করছে দেশে। বিভিন্ন সময়ে পাচারকৃত এসব মাদকের বড় বড় চালান ধরা পড়লেও তা প্রকৃত মাদকের চালানের তুলনায় নগন্য বলে জানা গেছে। কারণ সীমান্তে এসেই মাদকের চালান নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন রুট দিয়ে পাচার হতে থাকে।
মাদকের এই সহজলভ্যতা দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়াচ্ছে। ছিন্নমূল ও বিচ্ছিন্ন মানুষদের পাশাপাশি স্কুল কলেজ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও জড়াচ্ছে মাদক সেবনে। এরপর হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে তারা সহিংসতায় লিপ্ত হচ্ছে। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তারা মানুষ হত্যা করতেও দ্বিধা করছে না। ছিন্নভিন্ন দেহের অঙ্গপ্রতঙ্গ নিয়ে উল্লাস করতেও দেখা যাচ্ছে তাদের।
পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, স্কুল-কলেজের অনেক শিক্ষার্থী এখন পর্ন দেখা ও ইয়াবা সেবনের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। মাদকের প্রভাবে তারা দ্রুত অপরাধের পথে ঝুঁকছে এবং অমানবিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়মিত মাদক সেবনের প্রভাবে অনেক অপরাধী হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, যার ফলে তারা জড়াচ্ছে নৃশংসতায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, অনলাইন অফলাইন এখন সব মাধ্যমেই মাদকের বিস্তার ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। মাদক নিয়ন্ত্রণে সরকারের ঘোষিত ‘জিরো টলারেন্স’ কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন জরুরি।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরাও সতর্ক করে জানিয়েছেন, তরুণ সমাজকে দ্রুত মাদক গ্রাস করছে। এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে দেশ মেধাবী ও দক্ষ জনবল সংকটে পড়বে।