Ridge Bangla

জোনাকি: রাতের আকাশের নক্ষত্র

জোনাকি পোকা বায়োলুমিনেসেন্স নামক একটি রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আলো ছড়ায়, যেখানে তাদের পেটের বিশেষ অংশে লুসিফেরিন নামক একটি রাসায়নিক এবং লুসিফেরেজ নামক একটি এনজাইম অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে। এই প্রক্রিয়ায় প্রায় কোনো তাপ উৎপন্ন না করেই আলো তৈরি হয়, যা তারা প্রধানত প্রজনন, যোগাযোগ এবং শিকার ধরা বা এড়ানোর জন্য ব্যবহার করে।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কবিতায় লিখেছেন, “ঝুমকো লতায় জোনাকি।” প্রকৃতির এই অদ্ভুত আলো জোনাকি পোকা ও কিছু বিশেষ কীটপতঙ্গের মধ্যে দেখা যায়। বিজ্ঞানীদের কাছে এটি পরিচিত ‘বায়োলুমিনেসেন্স’ বা জৈব আলোকধারা হিসেবে। যুগ যুগ ধরে জোনাকি পোকা মানুষের কৌতূহল ও গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু।

সম্প্রতি চীনের হুয়াজং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা জোনাকির আলো উৎপাদনের জন্য দায়ী দুটি জিনের সন্ধান পান। সিনহুয়া ফু জানিয়েছেন, জোনাকির লার্ভা পর্যায়ে আলো উৎপাদনের অঙ্গ বিকশিত হয়, যা প্রাপ্তবয়স্করা বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এই অঙ্গকে একটি লণ্ঠনের মতো কল্পনা করা যায়। যোগাযোগের ক্ষেত্রে জোনাকিরা মোর্স কোডের মতো আলোক সংকেত ব্যবহার করে।

জোনাকি পোকা মূলত ল্যামপাইরিডি পরিবারের বিটল, যা ইংরেজিতে ‘লাইটিং বাগ’ বা ‘ফায়ার ফ্লাই’ নামে পরিচিত। পৃথিবীতে প্রায় ২০ হাজার প্রজাতির জোনাকি রয়েছে। আলোর রঙ ও সংকেতও প্রজাতিভেদে আলাদা। কেউ সবুজ আলো দেয়, কেউ হলুদ বা কমলা। আলোর জ্বলন ধারাবাহিক নয়; এটি মাঝেমধ্যে জ্বলে এবং নেভে। পুরুষ জোনাকি আলো জ্বেলে ঘুরে নারী জোনাকির মনোযোগ আকর্ষণ করে। নারী জোনাকি নির্দিষ্ট আলো দেখে বংশবর্ধনের জন্য উপযুক্ত পুরুষ বাছাই করে। এক প্রজাতির নারী অন্য প্রজাতির পুরুষের সঙ্গে মিলনে যেতে পারে না।

জোনাকির আলোর রহস্য মূলত দুটি রাসায়নিক পদার্থ, লুসিফেরিন এবং লুসিফেরাজের মাধ্যমে। লুসিফেরাজ একটি এনজাইম যা আলো ছড়ায়, আর লুসিফেরিন আলোকে ঠান্ডা রাখে। এই কারণে জোনাকির আলোতে তাপ হয় না এবং শক্তির শতভাগ আলোতে রূপান্তরিত হয়।

জোনাকির খাদ্যাভ্যাসও বিশেষ। বাচ্চারা মাটিতে, গাছের বাকল বা স্যাঁতসেঁতে স্থানে কেঁচো, শামুক ও অন্যান্য পোকার বাচ্চা খেয়ে বড় হয়। ছোটবেলায় শত্রুর আকার বড় হলে দলবদ্ধভাবে আক্রমণ করে বিষ প্রয়োগ করে। প্রাপ্তবয়স্করা ঘাস, ঝোপঝাড়ে ঘুরে মধু ও পরাগগ্রহণ করে। নারী জোনাকি মিলনের পর ডিম পাড়ার পর মারা যায়, পুরুষরা মিলনের পর মারা যায়।

জোনাকি সাধারণত জলাভূমি ও স্যাঁতসেঁতে স্থানে বসবাস করে। তারা লম্বা ঘাস, ঝোপঝাড় বা গাছের বাকলকে তাদের আশ্রয় হিসেবে ব্যবহার করে। দিনের বেলায় গাছের ফাঁক, শুকনো পাতার নিচে বা ঘাসে লুকিয়ে থাকে। এন্টার্কটিকা ছাড়া পৃথিবীর সব মহাদেশে জোনাকি দেখা যায়। তবে বনাঞ্চল উজাড় হওয়া, আলো ও শব্দ দূষণ, পরিবেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও আবাসস্থল সংকোচনের কারণে তাদের সংখ্যা কমছে।

জোনাকির শত্রুর মধ্যে বাঁদুর প্রধান। রাতের সময় আলো জ্বালিয়ে চলাফেরার কারণে বাঁদুর সহজে তাদের ধরতে পারে। টিকটিকি বা সাপের মতো শিকারী জোনাকিকে তেমন ভয় দেখাতে পারে না। গবেষকরা মনে করেন, মানুষের ক্রমাগত হস্তক্ষেপ, বিশেষ করে আলো ও শব্দ দূষণ জোনাকির বংশবৃদ্ধি ও বেঁচে থাকার ক্ষমতা হ্রাস করছে।

জোনাকির আলো কেবল প্রজনন বা যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি প্রকৃতির এক অদ্ভুত আলোকসজ্জা। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য জোনাকি ব্যবহার করলেও মানুষের ক্রমাগত হস্তক্ষেপ তাদের সংখ্যা হ্রাস করছে। তাই জোনাকিরা যাতে আবার আমাদের আশেপাশের ঝোপঝাড় ও জলাভূমিতে ফিরে আসে, সেজন্য তাদের বসবাসের উপযোগী পরিবেশ সংরক্ষণ করা অপরিহার্য।

সঠিক সংরক্ষণমূলক উদ্যোগে সন্ধ্যার আকাশ জোনাকির ঝলমলে আলোয় আলোকিত হতে পারে, যা প্রকৃতির এক অপরূপ দৃশ্যমান রূপকে আমাদের সামনে তুলে ধরবে। জোনাকি শুধু আলো নয়, এটি প্রাকৃতিক যোগাযোগ, বংশবৃদ্ধি ও পরিবেশের সঙ্গে এক নিখুঁত সামঞ্জস্যের প্রতীক। এর রহস্য, সৌন্দর্য এবং পরিবেশগত গুরুত্ব আমাদের শেখায়- প্রকৃতির এই ছোট্ট আলোও সমান গুরুত্বপূর্ণ এবং সংরক্ষণের দাবি রাখে।

এই পোস্টটি পাঠ হয়েছে: ৩৯

আরো পড়ুন