৫ আগস্ট ২০২৪, সকাল ১১টা। বন্ধুর স্কুটিতে মিরপুর ১০ নম্বর পর্যন্ত গিয়ে নামলাম। আগের রাতে কারফিউর কারণে সাভার না গিয়ে বন্ধুর ষাট ফিট এলাকার বাসায় ছিলাম। রাস্তাঘাটে মানুষ প্রায় নেই, কেবল আর্মি-পুলিশ। মিরপুর কলেজের পাশের গলি দিয়ে যখন লাভ রোডের দিকে এগোচ্ছি, তখন গলির মুখে এবং মোড়ে মোড়ে ছাত্র-জনতা লাঠি হাতে জড়ো হয়ে আছে।
পল্লবী যাওয়ার জন্য রিকশায় উঠলাম, কিন্তু কিছুক্ষণ পরই সরকার দলীয় বাইকারদের ‘ধর ধর’ চিৎকারে রিকশাওয়ালা আমাকে নামিয়ে দিলেন। আমি অফিসিয়াল বেশ ধরে একা হেঁটে সামনে এগিয়ে গেলাম, ওরা আমাকে লক্ষ্য না করেই চলে গেল। এরপর রিকশা নিয়ে বিইউবিটি হয়ে দুপুর ১২টার দিকে পল্লবীর বাসায় পৌঁছাই। তখনও ইন্টারনেট বন্ধ, দুপুর ২টার দিকে ভাই ও বন্ধুর কাছ থেকে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের খবর পাই।
রাস্তায় নামতেই দেখি আনন্দের মিছিল, স্লোগানে মুখরিত জনতা: “পালাইছেরে পালাইছে, শেখ হাসিনা পালাইছে!” মিরপুর ১০ নম্বরে গিয়ে দেখি হাজারো মানুষ, ভিড়ে সামনের দিকে এগোনো যাচ্ছে না। পাশের রাস্তায় মিরপুর থানার সামনে আসতেই মুহুর্মুহু গুলির শব্দ। গুলিতে দুই তরুণ রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে। আতঙ্কে অনেকে পাশের সুইমিং পুল স্টেডিয়ামের দেয়াল টপকে পালাচ্ছে, আমিও তাদের সঙ্গে পালাই।
কিছুক্ষণ পর দেখি, ছাত্র-জনতার একদল সাহসী তরুণ-তরুণী হাতে লাঠি নিয়ে বাইকে চড়ে থানার ভেতরে ঢুকে যায়। জনতা চারদিক ঘিরে ফেলে থানাটি। পুলিশরা পাশের দালানের ছাদ থেকে বন্দুক তাক করে রেখেছে। এরপর থানার ভেতর থেকে ককটেল ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করা হয়। গোটা এলাকা কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যায়।
হঠাৎ তিনটি আর্মির গাড়ি আসে, ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে জনতাকে কিছুটা পেছনে সরিয়ে দেয়। তারপর পুলিশদের থানার ভেতর থেকে বের করে আনে। দেখলাম, সব পুলিশ নিজের পোশাক ফেলে সাধারণ পোশাকে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে- নিরুপায়, নিরস্ত্র, ভীত। এরপর গুলির আওয়াজের মধ্যেই তাদের আর্মির গাড়িতে করে মিরপুর থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।
পুলিশ সরিয়ে নেওয়ার পর জনতা থানায় আগুন ধরিয়ে দেয়। সেদিন আমি দেখেছি, জনগণের রাগ, প্রতিরোধ আর বিস্ফোরণ কতটা ভয়ংকর হতে পারে। কোনো বাহিনী, কোনো অস্ত্র, কোনো ক্ষমতা এই বিক্ষুব্ধ জনতার সামনে টিকে থাকতে পারে না।
তবু দুঃখ হয়, যখন দেখি এই বিপ্লবকে এক শ্রেণির মানুষ ‘জনবিপ্লব’ না বলে নিজেদের কৃতিত্বে রূপ দিতে চায়—ঠিক যেমন মুক্তিযুদ্ধের পরেও কিছু মুক্তিযোদ্ধা শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের মতো নিজেরাই পুরো অর্জনের মালিক হতে চেয়েছিল।