Ridge Bangla

খালেদা জিয়া: বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক কিংবদন্তি, গণতন্ত্রের আপোসহীন নেত্রী

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে খালেদা জিয়ার নাম অমর হয়ে লেখা আছে। দমন–পীড়ন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, ব্যক্তিগত দুঃখ–কষ্ট- কোনো কিছুই তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। বরং, এসব প্রতিকূলতার মধ্যেই তিনি দৃঢ়তা, ধৈর্য এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। নেতৃত্বের আসন তাঁর কাছে শুধুমাত্র ক্ষমতার প্রতীক নয়, বরং জনগণের আশা–আকাঙ্ক্ষা, ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং সংকটময় পরিস্থিতিতে দৃঢ় থাকার প্রতীক। তাই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতিটি অধ্যায়ে তিনি অপরিহার্য কান্ডারি হয়ে আছেন।

১৯৮২ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট পরিবর্তিত হয়। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর বিএনপির অস্তিত্বও হুমকির মুখে পড়ে। বিচারপতি আব্দুস সাত্তার দায়িত্ব নিলেও দলের জন্য প্রয়োজন ছিল এমন একজন নেতার, যিনি দল, রাষ্ট্র এবং গণতন্ত্রকে সংকটের মধ্যেও টিকে রাখতে পারবেন।

এই শূন্যতার মুহূর্তে খালেদা জিয়া নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপিতে প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণের তিন মাসের মধ্যেই দেশ সামরিক অভ্যুত্থানের অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখলের পরও তিনি প্রথম দিন থেকেই বিরোধিতা শুরু করেন।

এরশাদ যখন ‘এমএলআর ৮২’ নামে সামরিক ফরমান জারি করে বিরোধিতা সাত বছরের কারাদণ্ডযোগ্য অপরাধ ঘোষণা করেন, তখনই গণতন্ত্রের লড়াই কঠিন রূপ নেয়। বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার, দলীয় কার্যক্রম বন্ধ- এমন পরিস্থিতিতেও খালেদা জিয়া থেমে থাকেননি। ১৯৮৩ সালের মার্চে তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন। ১ এপ্রিল প্রথম বর্ধিত সভায় বক্তৃতা দিয়ে জানিয়ে দেন, বিএনপি শুধু টিকে থাকবে না, লড়বেও বাংলাদেশের মাটি–মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য।

এই সময়ে তিনি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে উঠে আসেন। তাঁর নেতৃত্বে গঠিত হয় সাত দলীয় ঐক্যজোট। ১৯৮৪ সালের ১০ মে তিনি বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারির সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের রক্ত ঝরলেও খালেদা জিয়া শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দেন, এই লড়াই শুধু ছাত্রদের নয়, গণতন্ত্রের। ১৯৮৪–৮৫ সালে বারবার গৃহবন্দিত্ব, গ্রেপ্তার ও মামলার মধ্যেও তিনি কর্মসূচি চালিয়ে যান।

১৯৮৬ সালে পাঁচ দফা দাবি নিয়ে তিনি আপসহীন অবস্থান নেন এবং সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকায় নির্বাচনে অংশ নেননি। ১৯৮৭ সালে ‘এরশাদ হটাও’ আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রদল নেতা মাহবুবুল হক বাবলুর মৃত্যুর পর আন্দোলন আরও উত্তাল হয়। ১৯৮৮ সালের একতরফা নির্বাচন প্রতিরোধেও তাঁর অবস্থান ছিল স্পষ্ট।

১৯৯০ সালে ছাত্রনেতা জেহাদের শাহাদাতের পর ২৪টি ছাত্রসংগঠন নিয়ে গঠিত হয় সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য। নূর হোসেনের শাহাদাতের পর আন্দোলন অগ্নিগর্ভ রূপ নেয়। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গণ–আন্দোলনটি পরে স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের পথ প্রশস্ত করে। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ পদত্যাগ করে নির্দলীয় সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।

১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। খালেদা জিয়া পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সবকটিতে জয়ী হন এবং জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য দলের সমর্থনে সরকার গঠন করেন। ২০ মার্চ তিনি ৩২ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। পঞ্চম জাতীয় সংসদে দুটি সংবিধান সংশোধনী, একাদশ ও দ্বাদশ, পাস হয়। একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কার্যক্রম বৈধ ঘোষণা করা হয়। দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করা হয় এবং উপরাষ্ট্রপতির পদও বিলুপ্ত হয়।

১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত পাঁচ দফা জাতীয় নির্বাচনে তিনি চারবার পাঁচটি আসনে এবং একবার তিনটি আসনে জয়ী হন। জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন; সততা, দেশপ্রেম, উন্নয়ন ও গণমানুষের কল্যাণ- খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে প্রতিফলিত হয়েছে। রাজপথের দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন বিএনপির আইকন।

অর্থনীতি, কূটনীতি, নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, আইন–শৃঙ্খলা, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন- প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য। মুক্তবাজার অর্থনীতি শুরু, আয়করের হার হ্রাস, শুল্ককাঠামো সহজকরণ, বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি, ভোলা ও দিনাজপুরে গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার, তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি- সবই তাঁর আমলে ঘটে। জাতিসংঘে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা দাবি এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তি বাস্তবায়নে তাঁর দৃঢ়তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

শিক্ষা খাতে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, দূরশিক্ষণ ব্যবস্থা, নারীর শিক্ষা বিস্তার- এসবই তাঁর উদ্যোগে বাস্তবায়িত হয়।

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনা–সমর্থিত জরুরি অবস্থায় বিএনপি ও জিয়া পরিবার রাজনৈতিকভাবে লক্ষ্যবস্তু হয়। ৭ মার্চ তারেক রহমান গ্রেপ্তার হন। খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর চেষ্টা ব্যর্থ হয়। সেপ্টেম্বরে তিনি ও আরাফাত রহমান কোকো গ্রেপ্তার হন।

২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মুক্তি পাওয়ার পর তিনি সমঝোতা প্রত্যাখ্যান করে নির্বাচনমুখী হন। ২০০৯ সালের পর বিভিন্ন বাধা ও মামলার মধ্যেও আন্দোলন চালিয়ে যান। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় তাঁর সাজার পর বিদেশে চিকিৎসাসেবা পাওয়া কঠিন হয়ে ওঠে।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর রাষ্ট্রপতির আদেশে তাঁর শাস্তি মওকুফ ও মুক্তির ঘোষণা আসে। ৭ আগস্ট তিনি বিএনপির মহাসমাবেশে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দেন।

বাংলাদেশে স্বৈরশাসন থেকে গণতন্ত্রের উত্তরণে খালেদা জিয়ার অবদান অনস্বীকার্য। গণমানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতীক এই মহিয়সী নেত্রীর জীবন ও নেতৃত্ব বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের স্থায়ী প্রতীক হিসেবে টিকে থাকবে অনন্তকাল।

এই পোস্টটি পাঠ হয়েছে: ২৮

আরো পড়ুন