পুলিশের বিরুদ্ধে অসন্তোষ, গ্রেপ্তার হওয়া নেতাকর্মীদের ছাড়ানোর চেষ্টা, কিংবা বিচারের দাবিতে দেশের নানা স্থানে বারবার থানা বা পুলিশি স্থাপনা ঘেরাওয়ের ঘটনা ঘটছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকাণ্ড নিয়ে জনমনে ক্ষোভ বাড়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রভাবশালী মহলের হস্তক্ষেপে থানার মতো একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বারবার চাপে পড়ছে। ২০২৫ সালের শুরু থেকে জুন পর্যন্ত এখন অব্দি প্রায় প্রতিমাসেই দেশের বিভিন্ন থানায় ঘটে চলেছে ঘেরাও, বিক্ষোভ কিংবা আটক ব্যক্তিকে ছিনিয়ে নেওয়ার মতো ঘটনা। এসব কার্যক্রম দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতির চিত্র ফুটিয়ে তুলছে প্রতিনিয়ত।
বছরের শুরুতেই জানুয়ারিতে পাঁচটি থানা ঘেরাওয়ের ঘটনা ঘটে। ১১ জানুয়ারি মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে উপজেলা যুবদলের সদস্য তরিকুল ইসলাম গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার সমর্থকরা থানায় হামলা চালিয়ে তাকে ছিনিয়ে নেয়। ৮ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানায় গাজী টায়ার কারখানার অগ্নিকাণ্ডে নিখোঁজদের খোঁজে স্বজনরা থানার সামনে জড়ো হন।
৬ জানুয়ারি চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানার সাবেক ওসিকে হেনস্তা করার পর আবার তার বিচারের দাবি করে স্থানীয় বিএনপি নেতারা থানা ঘেরাও করেন।
৪ জানুয়ারি গাজীপুরে আওয়ামী লীগ নেতা শফিকুল সিকদারকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে জামায়াত নেতারা বিক্ষোভ মিছিল করে থানা চত্বরে অবস্থান নেয়।
২৬ জানুয়ারি বনানী থানার সামনে চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে বস্তিবাসী বিক্ষোভ করেন।
জানুয়ারির মতো ফেব্রুয়ারিতেও ঘেরাও করা হয় ৭ থানা। ৪ ফেব্রুয়ারি উত্তরা পশ্চিম থানায় তিন ছাত্রকে আটকের ঘটনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা থানা ঘেরাও করেন। ১২ ফেব্রুয়ারি মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখানে নিখোঁজ এক স্কুলছাত্রের সন্ধানে সহপাঠী ও স্বজনরা থানার সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করে। একই দিন সাভারের হাইওয়ে থানায় থ্রি-হুইলার চালনোর অনুমতির দাবিতে অটোরিকশা চালকরা থানার গেট অবরোধ করে রাখেন।
২৪ ফেব্রুয়ারি শেরপুরের নকলা উপজেলায় এক কিশোরীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় বিচারের দাবিতে থানাকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ২৫ ফেব্রুয়ারি গাইবান্ধায় তিনজন ছাত্রনেতার ওপর হামলার ঘটনায় সদর থানার সামনে অবস্থান নেয় আন্দোলনকারীরা। ১৬ ফেব্রুয়ারি যশোরের মনিরামপুর থানায় ‘দাগি আসামিদের’ ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ তুলে বিএনপি নেতাকর্মীরা থানা ঘেরাও করেন।
জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারির ধারা চলে মার্চেও। এ সময় ঘেরাও করা হয় অন্তত ৯টি থানা। ১০ মার্চ সাতক্ষীরার তালা থানায় ছিনতাই ও অজ্ঞান পার্টির সাথে জড়িত অভিযোগে রিয়াজুল ইসলাম মোড়লকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি স্বেচ্ছাসেবক দলের বহিষ্কৃত নেতা। তার অনুসারীরা তাকে ছাড়াতে থানায় বিক্ষোভ করে। জানা যায়, রিয়াজুল একাধিক মামলার আসামি এবং ২০২৩ সালের আগস্টে জেল থেকে পালিয়েছিলেন।
৬ মার্চ রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানার সামনে অবস্থান নেন স্থানীয়রা। তারা মোঃ বিচ্ছাদ নামে এক ব্যক্তিকে ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ দাবি করে তাকে পুনরায় গ্রেপ্তারের দাবিতে বিক্ষোভ করেন, যদিও আদালত ওই ব্যক্তিকে জামিনে মুক্তি দিয়েছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে হেনস্তার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মচারীকে ছাড়াতে শাহবাগ থানার সামনে টানা ৮ ঘণ্টা অবরোধ করে রাখে একদল জনতা। একই দিন গাজীপুরের বাসন থানা পুলিশ এক পোশাক শ্রমিক নেতাকে গ্রেপ্তার করলে শত শত শ্রমিক থানা ঘেরাও করে তাকে ছিনিয়ে নেয়।
৯ মার্চ চট্টগ্রামের খুলশী থানায় ঘটে ব্যতিক্রমী ঘটনা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির প্রতিবাদে সাধারণ ছাত্র ও জনতা থানায় জবাবদিহির দাবিতে অবস্থান নেয়। ৭ মার্চ মাগুরায় শিশু ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেপ্তার আসামিদের কঠোর শাস্তির দাবিতে থানা ঘেরাও করে জনতা। ১৪ মার্চ মেহেরপুরে এক ধর্ষকের পক্ষে অবস্থান নেওয়া পুলিশের এসআই-এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা চেয়ে স্থানীয়রা থানা ঘেরাও করেন। ২৪ মার্চ যশোরে শিশু ধর্ষণচেষ্টায় অভিযুক্ত এক যুবককে আটকের পর তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থানায় অবস্থান নেয়।
এপ্রিল মাসে ঘটেছে দফায় দফায় থানা ঘেরাওয়ের ঘটনা। এ সময়ও অন্তত ১০ বার থানা ঘেরাও করা হয়। গত ১৬ এপ্রিল ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলায় যুবলীগ নেতা ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মতিউর রহমান মতিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ ঘটনায় তার সমর্থকরা বিক্ষোভ করে থানা ঘেরাও করে এবং তাকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। একই দিন কিশোরগঞ্জের ইটনা থানার ওসি মোঃ মনোয়ার হোসেনকে প্রত্যাহারের আদেশ বাতিল করে পুনর্বহাল করার দাবিতে থানা ঘেরাও করেন স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীরা।
২৪ এপ্রিল সমবায় সমিতির নামে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে জামালপুরের মাদারগঞ্জ থানায় গ্রেপ্তার হন জামায়াত নেতা মাহবুবুর রহমান। তাকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে- এমন খবরে ক্ষুব্ধ আমানতকারীরা থানায় বিক্ষোভ করে অবস্থান নেয়।
এর আগে ১৭ এপ্রিল চট্টগ্রামের আকবর শাহ থানায় পাল্টাপাল্টি অবস্থান নেয় ছাত্রদল ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। ৮ এপ্রিল নাটোরের লালপুরে জেলা ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক রুবেল উদ্দিনকে গ্রেপ্তারের পর তার অনুসারীরা থানা ঘেরাও করে তাকে জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
মে মাসে ঘেরাও হয় ৬ থানা। গত ২৯ মে চট্টগ্রামে বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলোর মোর্চা গণতান্ত্রিক ছাত্রজোটের কর্মসূচিতে হামলার এক ঘটনায় পুলিশ আটক করে দুজনকে। পরে তাদের মুক্তি দাবিতে কোতোয়ালি থানা ঘণ্টাব্যাপী সময় ধরে ঘেরাও করে রাখে ‘অ্যান্টি-শাহবাগ মুভমেন্ট’ (শাহবাগবিরোধী ঐক্য) নামের একটি সংগঠন।
এর দুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে চোর অপবাদ দিয়ে নিউমার্কেট এলাকার ব্যবসায়ীদের মারধরের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা নিউমার্কেট থানা ঘেরাও করে। গত ১৬ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যায় ‘প্রকৃত’ আসামিদের গ্রেপ্তারের শাহবাগ থানা ঘেরাও করা হয়। গত ১২ মে নেত্রকোনায় এক নাশকতা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া খেলাফত আন্দোলনের শ্রমিক নেতা ও ‘হোটেল শ্রমিক সংগঠনে’র সভাপতি আনোয়ার হোসেনকে ছাড়াতে থানা ঘেরাও করেন দলটির নেতা-কর্মীরা।
চলতি জুন মাসেও হয়েছে পাঁচবার থানা ঘেরাওয়ের ঘটনা। চলতি মাসের ২৫ জুন পর্যন্ত এখন অব্দি দেশে অন্তত পাঁচবার থানা ও পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনা ঘেরাওয়ের ঘটনা ঘটেছে। বিএনপির নেতাকর্মীরা গত মঙ্গলবার খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) কার্যালয় ঘেরাওয়ের পর মূল ফটকে তালা ঝুলিয়ে ব্যাপক বিক্ষোভ করেন।
চাঁদাবাজির একটি মামলায় গত ২০ জুন গ্রেপ্তার হওয়া ইসলামী আন্দোলনের এক নেতাকে ছাড়িয়ে নিতে চান্দগাঁও থানা ঘেরাও করেন দলটির নেতাকর্মীরা। চাপে পড়ে পুলিশ পরদিন ওই নেতাকে আদালতে না পাঠিয়ে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এর একদিন আগে নামের ভুলে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা খন্দকার নূরনবী কাজলকে গ্রেপ্তার করা হলে তাকে ছাড়াতে থানা ঘেরাও করেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা।
ডিএমপির তুরাগ থানায় পদায়ন হওয়া এস এম শাহাদাত হোসেন নামে এক ইন্সপেক্টরের যোগ দেওয়া ঠেকাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা গত ১৭ জুন থানার গেটে বিক্ষোভ করেন।
দেশজুড়ে এভাবেই চলছে সাধারণ ঘটানাকে কেন্দ্র করেও থানা ঘেরাওয়ের কর্মসূচি। রাষ্ট্রীয় একটি প্রতিষ্ঠানের কাজে বারবার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে বিভোক্ষ ও জন-অসন্তোষের নাম করে। দেশে মামলার জট, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঠেকাতে যেখানে পুলিশ হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে বাড়তি ঝামেলা হয়ে এসেছে এই ‘ঘেরাও’ কর্মসূচি।
সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক মনে করেন, এমন ঘেরাও সংস্কৃতি থামাতে হলে পুলিশকে প্রথমেই দায়িত্বশীল হতে হবে। তিনি বলেন, “জড়িত ব্যক্তি যে-ই হোক না কেন তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে। রাজনৈতিক বা সামাজিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করলে পুলিশের বিশ্বাসযোগ্যতা ও জনগণের প্রতি গ্রহণযোগ্যতা ফিরবেনা। তিনি আরও বলেন, “রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলোরও সচেতনভাবে বিবেচনা করা উচিত যে তারা নিজেদের স্বার্থে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে কতটা হুমকির মুখে ফেলছে।”