মানবসভ্যতার ইতিহাসে সময়কে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডিতে মাপার জন্য মানুষ তৈরি করেছে নানা রকম বর্ষপঞ্জি। বাংলা বর্ষপঞ্জিও এর ব্যতিক্রম নয়। কৃষকের ক্ষেত, ব্যবসায়ীর হালখাতা, কিংবা শহরের রঙিন মঙ্গল শোভাযাত্রা- সবকিছু মিলে বাংলা বর্ষপঞ্জি বাঙালীর জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।
এই ইতিহাস যতটা জ্যোতির্বিদ্যার, ততটাই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার গল্পও বটে। সময়ের বিবর্তনে কীভাবে বাংলা পঞ্জিকা আবির্ভূত হলো? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে শত শত বছর পেছনে, বাংলা বর্ষপঞ্জির শেকড়ের সন্ধানে।
প্রাচীন জ্যোতির্বিদেরা আকাশ পর্যবেক্ষণ করে সূর্যের গতি ও নক্ষত্রপুঞ্জের সঙ্গে আকাশের সম্পর্ক নির্ণয় করতেন। কৃষিকাজের জন্য উপযুক্ত সময় নির্ণয় ও ফসল কাটার পর কর আদায়ের সঠিক সময় নির্ধারণ করার জন্য এটি প্রয়োজন হতো। সূর্যের গতিপথ বিশ্লেষণ করে তারা আকাশকে বারোটি ভাগে বিভক্ত করেন, যা রাশিচক্রের বারোটি চিহ্নের সঙ্গে মিলে যায়। সূর্যের এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে প্রবেশের ঘটনাকে বলা হয় সংক্রান্তি, যা নতুন মাসের সূচনা নির্দেশ করে। এভাবেই বাংলা পঞ্জিকার বারো মাস গঠিত হয়।

বাংলা বর্ষপঞ্জির স্বতন্ত্র বিকাশ শুরু হয় সপ্তম শতকে, রাজা শশাঙ্কের শাসনামলে। তার আমলের কিছু প্রাচীন শিব মন্দিরে ‘বঙ্গাব্দ’ শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়। এই সময় বাংলায় শক নামে এক বর্ষপঞ্জির ব্যবস্থার প্রচলন ঘটে। দশম শতকে রচিত সূর্যসিদ্ধান্ত গ্রন্থটি সময় গণনার এক ঐতিহ্যবাহী দলিল। এই গ্রন্থেই প্রথম ‘বৈশাখ’ শব্দটিকে বাংলা বছরের প্রথম মাস হিসেবে উল্লেখ করা হয়। পাল যুগের শিলালিপি ও বৌদ্ধ গ্রন্থে ‘আশ্বিন’ নামের মাসের উল্লেখ পাওয়া যায়।

মধ্যযুগে মুঘল সাম্রাজ্য সমগ্র ভারতবর্ষে প্রশাসনিক কাজে হিজরি পঞ্জিকা ব্যবহার করত। কিন্তু হিজরি পঞ্জিকা চান্দ্র বর্ষপঞ্জির উপর ভিত্তি করে গঠিত হওয়ায় কৃষি ও কর ব্যবস্থার সঙ্গে একে মেলানো কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ হিজরি বর্ষ সৌর বছরের তুলনায় প্রতি বছর প্রায় ১১ দিন কম হয়। ফলে তা কৃষিভিত্তিক বাংলার জন্য বড় সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এই সমস্যার সমাধানে মুঘল সম্রাট আকবর জ্যোতির্বিদ ফতেহউল্লাহ শিরাজিকে নতুন একটি বর্ষপঞ্জি তৈরির দায়িত্ব দেন। তিনি ভারত ও বাংলায় প্রচলিত শক বর্ষপঞ্জিকে হিজরি পঞ্জিকার সঙ্গে মিলিয়ে ‘তারিখ-ই-ইলাহি’ নামে একটি নতুন বর্ষপঞ্জি প্রবর্তন করেন। সাধারণ মানুষের কাছে এটি ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিতি পায়।
এই নতুন বর্ষপঞ্জির গণনা শুরু হয় হিজরি ৯৬৩ সালে, আকবরের সিংহাসনে আরোহণের বছর থেকে। যে বছর আকবর সিংহাসনে আসীন হন, সেই বছর হিজরি মাস মহরমের সঙ্গে শক বর্ষপঞ্জির বৈশাখ মাসের সামঞ্জস্য পাওয়া যায়। তাই বৈশাখকে নতুন বছরের প্রথম মাস হিসেবে নির্ধারণ করা হয়।

আকবরের তারিখ-ই-ইলাহির মাসগুলোর নাম রাখা হয়েছিল পারস্যের বর্ষপঞ্জি অনুসারে- ফরওয়ার্দিন, আরদিবেহিশত, খুরদাদ, তীর, মর্দাদ, শহরিবার, মেহ ইত্যাদি। কিন্তু এই নামগুলো বাংলার সাধারণ মানুষের কাছে একেবারেই অপরিচিত ছিল। বাংলার মানুষ বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ ইত্যাদি নামে মাস চিনত। এমনকি নতুন পঞ্জিকায় প্রতিটি দিনের জন্য আলাদা নামকরণ করা হয়েছিল, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে গ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
পরবর্তীতে সম্রাট শাহজাহান শক ও বিক্রম সংবৎ পঞ্জিকার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলা মাসগুলোর প্রচলন পুনরুদ্ধার করেন। ফলে ‘বঙ্গাব্দ’ নামে পরিচিত বর্তমান বাংলা পঞ্জিকার ভিত্তি স্থাপিত হয়।
সম্রাট জাহাঙ্গীরের নির্দেশে সুবেদার ইসলাম খাঁ চিশতি ঢাকাকে যখন রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলেন, তখন থেকেই রাজস্ব আদায় ও ব্যবসা বাণিজ্যের হিসাব-নিকাশ শুরু করার জন্য পহেলা বৈশাখকে উৎসবের দিন হিসেবে ধরা হয়। যদিও সময়ের সাথে বাংলা পঞ্জিকার অনেক পরিবর্তন এসেছে, তবে এর মূল ভিত্তি একই রয়ে গেছে।

মঙ্গল শোভাযাত্রা
বাংলা নববর্ষ মানেই নব আনন্দের সূচনা, অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদ। এই ভাবনা থেকেই জন্ম মঙ্গল শোভাযাত্রার, যেখানে মুখোশ, আল্পনা ও নানা শিল্পকর্মের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয় বাংলার লোকজ সংস্কৃতি।
১৯৮৬ সালে যশোরের চারুপীঠ নামে একটি প্রতিষ্ঠান প্রথমবারের মতো নববর্ষ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করে, যেখানে ছিল পাপেট, বাঘের প্রতিকৃতি আর ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র। পরে ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় শুরু হয় অনুরূপ শোভাযাত্রা, যা পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে পরিচিতি পায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে এই শোভাযাত্রার আয়োজন করে। বিশ্বজুড়ে বাঙালি সংস্কৃতির অনন্য পরিচায়ক এই শোভাযাত্রা ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কোর ‘অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের’ তালিকায় স্থান করে নেয়।

অনেকেই মনে করেন মঙ্গল শোভাযাত্রা আমাদের গৌরবময় সংস্কৃতির একটি অংশ, যা বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ফুটিয়ে তোলে। বিভিন্ন প্রতীক, মুখোশ ও শিল্পকর্মের মাধ্যমে এতে প্রকাশ পায় বাংলার লোকজ ঐতিহ্য ও সাম্যের বার্তা। অন্যদিকে, কেউ কেউ মনে করেন, এটি ক্রমে শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। অনেকেই প্রশ্ন তোলেন, এটি কি সত্যিই সার্বজনীন উৎসব, নাকি নির্দিষ্ট একটি শ্রেণির সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে?
তবে এ কথা সত্য যে, মতপার্থক্য থাকলেও মঙ্গল শোভাযাত্রা বর্তমানে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। সময়ের সঙ্গে এর রূপ ও ব্যাখ্যা বদলাতে পারে, কিন্তু এর মূল চেতনা আজও অবিকৃত আছে।
তথ্যসূত্র
১) বাংলা বর্ষপঞ্জি যেভাবে এলো - কালবেলা
২) বাংলা সন ও পঞ্জিকার ইতিহাস-চর্চা এবং বৈজ্ঞানিক সংস্কার, বাংলা একাডেমি ঢাকা, সম্পাদনা- শামসুজ্জামান খান
৩) বৃহৎ বঙ্গ, প্রথম খণ্ড, রায়বাহদুর দীনেশচন্দ্র সেন, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা
৪) কেন মঙ্গল শোভাযাত্রা? – বাংলা ট্রিবিউন
৫) The mystery of Pahela Baishakh and the Bengali calendar – The Daily Star.